রবীন্দ্র সঙ্গীত সার্বজনীন মহামিলন, মূল্যবোধ ও দর্শনের পথিকৃৎ
ড. ফোরকান উদ্দিন আহম্মেদ
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সমগ্র প্রসঙ্গে কিছু বলতে যাওয়া সমুদ্র মন্থনের মতো এক দুরূহ কাজ। তার সমগ্র রচনার পরিচয় আজও মেলেনি। কত গান, কত ছবি, কত চিত্রকলা, কত কথকতা, কত লিপি, কত দিনলিপি, কত সংসাবাণী, কত আশীর্বাণী, কত অটোগ্রাফ, কত পা-ুলিপির হিসাব আজও দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে কে বলবে। রবীন্দ্রণাথের কাব্য-প্রতিভার পাশাপাশি তার সঙ্গীত প্রতিভাও সমুজ্জ্বল। কি গানের বাণী, কি গানের সুর, দুটোতেই তিনি ছিলেন কৃতীপুরুষ। সঙ্গীতভূবনে তার এই অবদান চিরঅম্লান হয়ে রয়েছে। গীতিকার ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ একজন উচ্চমানের গায়ক হিসেবে, প্রভূত সুনাম অর্জন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের গানে এক কল্পভূবন জেগে ওঠে মনে। তার নৃত্য তরঙ্গিত প্রবাহে সব সত্তা যেন ডুবে যায়। গান শেষ হলেও কিছুক্ষণ মোহ মায়ায় ছেয়ে থাকে বাইরের আর ভেতরের আকাশ। সঙ্গীতশিল্পী রবীন্দ্রনাথের অনুভূতিতে বাণী ও সুর সমান মর্যাদা পেয়েছে। কথায় যা আছে তার অতীত আর সব স্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে তার গানে। তার গানে যে বিস্ময়কর সিদ্ধি ও সার্থকতা তার মূল কারণ তিনিই রচয়িতা এবং তিনি সুরকার। এই দুইয়ের মিলনে রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠেছে মাধুর্যের আধার। রবীন্দ্রনাথ তার গীতি কবিতার কথা সম্পর্কে বলেছেন যে, গান রচনা অর্থাৎ সঙ্গীতের সঙ্গে বাণীর মিলন সাধনাই তার সাধনা। এই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ সুরকার। সুরের জাদুকর। তার গানের বাণীর সঙ্গে সুরের মিলন তুলনার ঊর্ধ্বে। সুরের সঙ্গে তার বাণী মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেছে। মনে হয়, যেন তিনি বিনি সুতোয় গানের মালা গেঁথেছেন। সুরকার রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলোÑ গানের ভাব ভাষা তথা রস অনুযায়ী রাগের প্রয়োগ, সার্থক রাগ প্রয়োগ, বাংলা তথা বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের সুরের সুন্দর প্রয়োগ, পাশ্চাত্য সুর ও নিজের সুরের সমীকরণ এবং বিবাদী স্বরের সার্থক প্রয়োগ। সুরকার রবীন্দ্রনাথ তার সৃজনশীল প্রতিভার গুণে কুপম-ুকতার উপরে উঠে গতানুগতিক ধারা পরিহার করে সকল প্রথাগত সংস্কার অস্বীকার করে বাংলা গানের জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার ভাই সৌমন্দ্রেনাথ ঠাকুর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তিনি ভাবকে মেনেছেন উপকরণ হিসেবে, সুরকেও লঘু করেননি, তার সুষমা ও শালীনতা অক্ষুণœ রেখেছেন।’ রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই এই দুরূহ কাজ সাধন সম্ভব হয়েছে। গান মানবধর্মী ও ব্যক্তিধর্মী হয়েছে। সঙ্গীতের ভূবনে এক নতুন ধারার সংযোজন হয়েছে। এই অসামান্য কীর্তির সব প্রশংসা একমাত্র তারই প্রাপ্য।
গায়ক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের জীবন গীতিকার ও সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই শুরু। পরিবারে গানের চর্চার ভেতর দিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছেন। গানের পরিম-লে বাস করে গান গাইবেন না, তা হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। বাল্যকালের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘মনে আছে বাল্যকালে গাদাফুল দিয়া ঘর সাজাইয়া মাঘোৎসরের অনুকরণে আমার খেলা করিতাম। সে খেলার অনুকরণে আর সমস্ত অঙ্গ একেবারেই অর্থহীন ছিল, কিন্তু গানটা ফাঁকি ছিল না। এই খেলার ফুল দিয়ে সাজানো একটা টেবিলের উপর বসিয়া আমি উচ্চকণ্ঠে ‘দেখিলে তোমার এই অনুল প্রেম-আননে; গান গাহিতেছি, বেশ মনে পড়ে।’ বাল্যকালে নিয়মিত সঙ্গীত চর্চা না করলেও বাড়িতে সাঙ্গীতিক পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্বন্ধে তার ধারণা জন্মেছিল ছোটবেলা থেকেই। তার নিজের জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘ছেলেবেলায় যেসব গান সর্বদা আমার শোনার অভ্যাস ছিল, সে শখের দলের গান নয়, তাই আমার মনে কালোয়াতি গানের একটি ঠাট আপনা আপনি জমে উঠেছিল। কালোয়াতি সঙ্গীতের রূপ ও রস আমার মধ্যে পাকা হয়ে উঠেছিল।
শৈশবকালে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের স্বর বেশ মিষ্টি ছিল। পারিবারিক বন্ধু শ্রীকণ্ঠ সিংহ এবং কবির পিতা শিশু-গায়ক ও সুকণ্ঠ রবীন্দ্রনাথের অন্যতম সমঝদার ছিলেন। কণ্ঠের মিষ্টি ও সুরেলা সম্পদের জন্য পিতা বালকপুত্রকে ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন, ‘রবি আমাদের বাংলাদেশের বুলবুল’। পারিবারিক ঘরোয়া পরিম-লে গান গেয়ে আসর মাত করে দিতেন বালক-গায়ক রবীন্দ্রনাথ। তার গলার যেমন সুর, তেমনি ছিল গান। এভাবেই সেই অল্প বয়সে কবি গীত পরিবেশনায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। অল্প বয়সকালে তিনি গান গাইতে কখনো ক্লান্তিবোধ করতেন না। কণ্ঠ মাধুর্যের জন্য কবির একটা গর্ববোধও ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তার কণ্ঠের সেই মিষ্টি সুর অবশ্য ছিল না। কবিও আক্ষেপ করে সে কথা বলেছেন, ‘আমার অল্প বয়সের সে গলা আর নেই। তোমাদের এখন আর কি শোনাব? পেয়েছিলুম বটে একটি গলার মতো গলা কিন্তু ভগবান কেড়ে নিয়েছেন, এখন কি আর গান গাইতে ইচ্ছে করে? তখন ‘বাতাসে’ ছেড়ে দিতাম সুর, পাখির মতো সে উড়ে চলত ধাপে ধাপে পর্দায় পর্দায়।’
রবীন্দ্রসঙ্গীত কেন সারাদেশের মানুষের গাইবার জন্য তাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে না, এ গান কেন শুধু বাঙালি মধ্যবিত্তদের নিছক চিত্তবিনোদনী গান থেকে যাবে। তাহলে এ গানের সমাজ-ধর্ম-মানব দর্শন কী করে দেশের সবাইকে জীবনপথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো চেয়েছিলেন তার গান সবাই গাইবে, তবু এদেশের রবীন্দ্রসঙ্গীত আন্দোলন কেন শুধ মধ্যবিত্তদের মঞ্চে আটকে আছে। তবু রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত আশাবাদী ছিলেন, জীবনের শেষ নিঃশ্বাসের প্রাক্কালেও ‘ওই মহামানব আসে’ এই গান রচনা করেছিলেন, যে গানে মহামানব কোনো ব্যক্তি নয়, একটি পরম কাম্য মূল্যবোধ।
লেখক: উপ-মহাপরিচালক ও কমান্ড্যান্ট (পিআরএল), আনসার-ভিডিপি একাডেমি, সফিপুর, গাজীপুর
সম্পাদনা: আশিক রহমান