‘ঢাকার রাস্তায় পানি, ভেনিসের কথা জানি’
কাকন রেজা
ঢাকার রাস্তার পানি নিয়ে কেউ কেউ কাব্য করছেন। শিরোনামটি তেমনি একটি কাব্যাংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন কাব্য দেখে কারো রাগ হতে পারে। ভাবতে পারেন, মানুষের দুর্দশা নিয়ে যারা কাব্য করতে পারে তাদের মানসিক স্থিতি বিষয়ে, এমন ভাবনাও দোষের নয়। কিন্তু ‘অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর’ বলে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। ভারতের এক পুলিশ আধিকারিক বলেছিলেন, ‘যখন তুমি নিশ্চিত যে ধর্ষণ অনিবার্য, তখন তা উপভোগ করো।’
পানি বিষয়ে এবং বর্তমান পারিপার্শ্বিকতায় যারা রাগ করেন, মনোক্ষুণœ হন তাদের প্রচলিত ‘প্রবাদ’টির সঙ্গে ভারতের পুলিশ আধিকারিকের কথাটি ভেবে দেখা দরকার। প্রতিকারহীন, প্রতিরোধ ব্যর্থ, ‘অনিবার্য’ এমন সব ঘটনায় মানুষ আর কিইবা করতে পারে, উপভোগ ছাড়া! দুঃখেও কেউ কেউ হাসেন, সুতরাং কেউ ‘অনিবার্য’তায় বাধ্য হয়েই কাব্যি করেন, করতে পারেন। এতে রাগ করার বা বিস্মিত হবার কিছু নেই।
যারা মালিবাগ থাকেন, যারা রাজারবাগ থেকে মালিবাগ যেতে চান তাদের অবস্থাটা ভেবে দেখুন তো। আজ প্রায় এক দশক ধরে তাদের যন্ত্রণার বিষয়টি বোধে আনুন। প্রতিকারহীন, প্রতিরোধ ব্যর্থ এই যন্ত্রণায় তারা কী করতে পারেন। ভাড়াটিয়ারা নয় তাদের অবস্থান বদলাতে পারেন, কিন্তু স্থায়ীরা কী করবেন? খিলগাঁও, শাজাহানপুরের বাসিন্দাদের কথাই ধরুন, বর্ষায় কাপড় না ভিজিয়ে তাদের রাস্তায় বেরোনো কতটা সম্ভব? মতিঝিল, রামপুরা এমনকি ফার্মগেট, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব। সুতরাং মনের দুঃখে কাব্যি করা কিংবা হেড়ে গলায় ‘জীবনমুখি’ গান গাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ফর্মুলা আছে কি?অবশ্য কাউকে কাউকে দেখেছি সামাজিকমাধ্যমে বিপ্লবী সাজতে, আন্দোলন, প্রতিরোধ এসব নিয়ে কথা বলতে। এমন এক মন্তব্যের প্রতিমন্তব্যে একজন বললেন, ‘সিদ্দিকুর হতে চান? চোখ সামলে রাখুন।’ চোখ আসলেই সামলে রাখা উচিত। পানিবদ্ধতা দৃষ্টিবদ্ধ হয় বলেই প্রতিকার, প্রতিরোধের কথা মাথায় আসে। দৃষ্টিবদ্ধ না হলেই কোনো ঝামেলা নেই। সুতরাং চোখ তো সামলে রাখাই উচিত। বস্তুবাদীদের কাছে দৃশ্যমানতাই মূল বিষয়। তারা দৃষ্টিবদ্ধ বিষয়গুলোকেই মূল সত্য বলে মানে। সুতরাং বস্তুবাদ নয় ভাববাদের চর্চা করতে হবে। ভাবতে হবে সব ঠিক আছে। ভাবনাটাই তো ‘অনিবার্য’। যেমন ভাবেন আমাদের অনেক অগ্রজরা (কামে না নামে তা পাঠকের বিবেচ্য)। তাদের বদ্ধ চক্ষুদ্বয়ে ঢাকা হয়ে উঠে প্রাচ্যের ‘ভেনিস’। তারা পানিমগ্ন রাস্তায় নিওনের প্রতিবিম্বিত আলোতে দেখেন ‘ভেনিসে’র মোহময় রূপ। অপরূপ সেই রূপের মহিমায় ক্রমেই অপরাপর দৃশ্য সকল ‘ভেনিশ’ হয়ে যায়। চক্ষুমুদে থাকা অবশ্যই জ্ঞানীর লক্ষণ। প্রাচীনকালের সব সাধু-সন্তরা চক্ষু মুদেই ধ্যান করতেন, ‘প্রভু’র দর্শন লাভের আশায় তারা একাগ্র থাকতেন মনচক্ষু উন্মিলনে। আমাদের বর্তমান অগ্রজরাও হয়তো চক্ষুমুদে ‘প্রভু’ বা ‘দেবতা’ দর্শনে ব্যস্ত। তবে প্রাচীন সাধুদের ‘দেবতা’র সঙ্গে, বর্তমান ‘দেবতা’দের প্রকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে। আর প্রাচীন সাধু-সন্তদের চাওয়ার সঙ্গে বর্তমান দেবঅন্তদের চাওয়ারও পার্থক্য আছে। সে সময় ‘বর’ হিসেবে চাওয়া হতো ‘জ্ঞান’, এখন চাওয়া হয় ‘দান’। মানে ‘দানে ধন বৃদ্ধি’ এই ফর্মুলা আর কী?
ফুটনোট : সিদ্দিকুর তার চোখ হারিয়েছেন। ন্যায্যতা আর ন্যায়তার প্রতি দৃষ্টিপাতই তার দৃষ্টি নির্বাপণের কারণ। আমাদের এ যুগের সাধু-সন্ত(?)রা এটা বোঝেন বলেই হয়তো, চক্ষুমুদে থাকেন, ‘অনিবার্য’তায় ধ্যানমগ্ন থাকেন।
পুনশ্চ : ‘চক্ষু মুদে থাকি কৃপার আশায়, ধন্য হব তাহার ভালোবাসায়’ এমন কাব্যি’র চরণ অনুযায়ী ভালোবাসা না মিললেও পানিবদ্ধতাহীন ভালো ‘বাসা’ এবং চলার রাস্তা যে মিলবে তেমন আশা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান