ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের নেতিবাচক বিষয়ে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান ধর্ম বা জাত বিবেচনায় নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতেই প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিয়েছি : প্রধানমন্ত্রী
আনিসুর রহমান তপন : প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি ধর্ম কিংবা জাত-পাত বিবেচনা করে কাজ করি না। যোগ্যতার ভিত্তিতেই নিয়োগ দিই। মানুষ হিসেবেই সিনহা সাহেবকে নিয়োগ দিয়েছি। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে তিনি যে রায় দিয়েছেন, আমি তা ইতিবাচকভাবে দেখছি।
প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদকে বলেন, আমি কোনো ভুল করিনি। আপনারা এ বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন। রায়ে যেসব আপত্তি রয়েছে সেসব নিয়ে জনমত তৈরি করুন। প্রধানমন্ত্রী রায়ের কপি হাতে নিয়ে বলেন, এতে যা লেখা আছে তাতে দেখলাম রায়ের কোথাও কোথাও সরকার এবং জনগণ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে। কাজেই আপনারা যেখানেই সুযোগ পাবেন সেখানেই রায়ের যে অংশে অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর মন্তব্য করেছে তা পরিষ্কার করে জনগণকে জানাবেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে জনমত গড়ে তুলুন। তারা যেন বুঝতে পারে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে যে রায় দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত তাতে কী কী বলা হয়েছে। কারণ, আমরা জনগণের প্রতিনিধি এবং তাদের কাছে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার বিষয় রয়েছে। কাজেই জনগণের এসব বিষয় জানার অধিকার আছে।
গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অনির্ধারিত আলোচনায় ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে ক্ষুব্ধ মন্ত্রীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী এসব তথ্য জানান।
তথ্যমতে, বৈঠকের পরই কয়েকজন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কথা বলেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংখ্যালঘু হিসেবে আমি বিচার করি না। তার নিয়োগের সময় অনেকেই বলেছেন, একজন সংখ্যালঘুকে এই পদে নিয়োগ দিয়ে আমি ভুল করেছি। আজও অনেকেই এটা বলছেন। আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি যা ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন। আমাদের সময়েই এরকম একটা রায় হয়েছে। এটা অবশ্যই ভালো দিক। এখন আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিনিয়র সদস্য জানান, মন্ত্রিসভায় অনির্ধারিত আলোচনা শুরু করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি নিয়ে হাজির হন। এসময় রায়ের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে যেসব বিষয় এসেছে এর বিস্তারিত অবহিত করেন। এর পরই শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা। আলোচনা চলে প্রায় দুই ঘণ্টা। একটি বিষয়ে এর আগে কোনো মন্ত্রিসভায় এত আলোচনা হয়নি।
সূত্র জানায়, ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য। রায়ের কয়েকটি অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে আনিসুল হক জানান, এখানে অনেক অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যা প্রয়োজন ছিল না। যেমন, রায়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনীর প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। এ রায়ে সংসদকে ইমম্যাচিউর্ড বলা হয়েছে। তাছাড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে রায়ে আরও অনেক আপত্তিকর বক্তব্য রয়েছে।
তবে রায়ের অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর মন্তব্য বিষয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে এক্সপাঞ্জ করার জন্য পিটিশন দেওয়া হবে বলে জানান মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য।
আরেকটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ ধারা যুক্ত হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। এতে সেসময়কার গণপরিষদের ৪০৩ জন সদস্যও যুক্ত থাকেন। ’৭৭ সালে বাংলাদেশের সামরিক সরকার সংবিধানের ৯৬ ধারা বাতিল করে বিশ্বের একমাত্র দেশ পাকিস্তানের আদলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে। যা ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রবর্তন করেন। এ ধরনের উদ্ভট একটি ব্যবস্থা পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নেই। একমাত্র পাকিস্তানেই আছে। আর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বর্তমান সরকার চেয়েছিল বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্সসহ শীর্ষ গণতান্ত্রিক দেশের আদলে বাংলাদেশের মূল সংবিধানের ৯৬ ধারা পূনর্বহাল করতে। সর্বোচ্চ আদালত এর বিরুদ্ধে রায় দেওয়ায় আপাতত সেটা পুনর্বহাল করা যাচ্ছে না। তবে আমাদের একটা দুঃখ, প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানের ব্যবস্থা বাংলাদেশে কায়েম করতে চাইছেন কেন? মন্ত্রিসভার এ সদস্য জানান, ৯৬ ধারায় বিচারপতিদের বিষয়ে অধিক নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ৩ সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। এই কমিটি কোনো অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। তার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। বিপরীতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে এই সদস্য বলেন, এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ উঠলে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন সংসদে পাঠানো হয়। সেখানে তা নিয়ে বিতর্ক হয় এবং দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পেলেই সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠালে তা অনুমোদন করতে পারেন রাষ্ট্রপতি।
এ ছাড়াও রায়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খর্ব করার কথা বলা হয়েছে যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় বলেও জানান মন্ত্রিসভার অপর এক সদস্য।
এক প্রশ্নের জবাবে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, পঞ্চম সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করা হয়েছিল। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন হলে সুপ্রিম কোর্ট এর ব্যাখ্যা দিতে পারেন, সংশ্লিষ্ট আইন বাতিল করা যেতে পারে। কিন্তু সংবিধান বাতিল করতে পারেন না। তিনি বলেন, রায়ে বলা হয়েছে, এই সংসদ ইমম্যাচিউর্ড এবং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। তাই যদি হয় তবে এই সংসদের সদস্যরাই ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছেন। তাহলে রাষ্ট্রপতির নিয়োগও প্রশ্নবিদ্ধ এবং তিনিও ইমম্যাচিউর্ড। কাজেই এমন প্রশ্নবিদ্ধ ও ইমম্যাচিউর্ড রাষ্ট্রপতি যখন এই প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিয়েছেন এবং তাকে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছেন, তাহলে প্রধান বিচারপতি কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ও ইমম্যাচিউর্ড-এর ঊর্ধ্বে থাকেন?
মন্ত্রিপরিষদ সূত্রে জানা গেছে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আজ সচিবালয়ে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী