যে খবরে বুক কেঁপে ওঠে!
আমাদের ছেলে-মেয়েরা যখন স্কুলে যায়, কোচিংয়ে যায় তখন অভিভাবক হিসেবে শঙ্কিত থাকতে হয়, ওরা ফিরে না আসা পর্যন্ত। কেন এ রকম হয়? এমনটি হওয়ার কি কথা ছিল? যেভাবে অপরাধ বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে ধর্ষণ ও খুন, তাতে উদ্বেগ আপনিই এসে হাজির হয়। শিক্ষাঙ্গণে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, এই হলো বাস্তবতা। বিভিন্ন মিডিয়ায় এসব খবর দেখলে বুক কেঁপে ওঠে।
শিশু থেকে বয়স্ক পর্যন্ত কেউ রেহাই পাচ্ছে না। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, সে দেশে খুন-ধর্ষণ মেনে নেওয়া যায় না। খুন-ধর্ষণের মতো গুর”তর অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশেই কমে আসবে। রোজ গণমাধ্যমে এসব বিষয়ে খবর আসছে। পত্রিকার খবরের বাইরেও দেশের আনাচ-কানাচে কত নারী যে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তার হিসাব নেই। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলোÑ মিডিয়া ও নাগরিকরা চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে কিংবা জোর প্রতিবাদ না জানালে প্রশাসন অপরাধকে আমলে নিতেই অনিচ্ছুক। দেশে অপরাধ করার পর অপরাধীরা খুব সহজেই নিষ্কৃতি পেয়ে যায়। নিষ্কৃতির এ জঘন্য সংস্কৃতিই অপরাধজগতের মানুষকে আরও জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করতে সাহস জোগায়। যেকোনো অপরাধই এখানে ‘সাধারণ’ বিষয়। অধুনা ধর্ষণ ও হত্যা, যেখানে দেড়-দুই বছরের শিশুও নিরাপদ নয়, আজ তা ‘সাধারণ’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নিপীড়ন-নির্যাতন, বিশেষ করে নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের দ্র”ত বিচার করতে হবে। বিলম্বিত বিচার, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ, ক্ষমতাবানদের প্রভাবের কারণে অনেক সময় আসামি পার পেয়ে যায়। অপরাধী যত শক্তিশালীই হোক না কেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা প্রভাব খাটিয়ে আইনের ফাঁক দিয়ে যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আইন সবার জন্য সমান। এই সত্যকে সমাজ তথা দেশের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাহলেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে।
ধর্ষণ ও খুনখারাবি, শিশু নির্যাতন যেহেতু বেড়েই চলেছে, তাই জনগণ আশা এসব মামলা দ্র”ত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দ্র”ত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন ও জাতীয় সংসদে কঠোর আইন পাস করে ৬০ দিনের মধ্যে এ জাতীয় অপরাধের বিচার শেষ করা। মানুষ আইন মান্য করে শাস্তির ভয়ে। উপযুক্ত বিচার হলেই পরবর্তী সময়ে আর কোনো মানুষ এসব অপকর্মে লিপ্ত হবে না। দ্র”ত বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। শিশুদের মধ্যে পারিবারিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষাকে ঐচ্ছিক না রেখে আবশ্যিক করতে হবে। শিশুর চরিত্র বিকাশের মহাবিদ্যালয় পরিবার। অপরাধমুক্ত দেশ ও জাতি গড়তে পারিবারিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার বিষয়ে গুর”ত্বারোপ করতে হবে। অভিভাবকদের নিজের সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। একটি শিশু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যা দেখে, তাকে যা দেখানো হয়, করানো হয়, তা-ই শেখে ও করে। শিশুরা টিভিতে নাটক-সিনেমায় অনেক অপরাধমূলক দৃশ্য দেখে। অভিভাবককে দেখতে হবে সন্তান কোথায় যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী করছে। সন্তান যাতে ভালো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশে নৈতিকতা বজায় রেখে চলতে পারে, প্রত্যেক অভিভাবককে সেদিকে যতœবান হতে হবে। শিশু-কিশোর-তর”ণদের জন্য খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের দেশে খুন ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধগুলোকে উসকে দিচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় যারা সন্ত্রাস করে, তাদের ব্যাপারে তো স্থানীয় প্রশাসন বরাবরই নিষ্ক্রিয়। তাই ক্রমাগতভাবে এ ধরনের অপরাধ বেড়েই চলছে। কিছুসংখ্যক মানুষ রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী নীরব ভূমিকায়; কখনো টাকা খেয়ে চোখ বন্ধ রাখছে। ক্ষমতা আর রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় থেকে মানুষ বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। অপরাধে ফেঁসে গেলে দল তখন অস্বীকার করে। এটা বাংলাদেশের রাজনীতির একটা কালচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১২৩ জন নারী ও শিশু। গত সাত মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫২৬টি। তাদের মধ্যে ১১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতন, ধর্ষণের জন্য কিছু মিডিয়া ও ফেসবুকের ফেক আইডিও দায়ী। ফেক আইডি দিয়ে কম বয়সী মেয়েদের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন সিরিয়াল দেখে ছাত্র-ছাত্রীরা বিপথগামী হচ্ছে। খুন ও ধর্ষণ তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুকে না বুঝে, না চিনেই তর”ণ-তর”ণীরা বন্ধু নির্বাচন করছে। তাদের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ ঘটছে। এর ধারাবাহিকতায় অবাধে সাক্ষাৎ হচ্ছে, মেলামেশা হচ্ছে। মেলামেশার একপর্যায়ে চাওয়া-পাওয়ার অমিল হলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। আর ধর্ষণকে চাপা দিতে খুনের ঘটনাও ঘটছে। এসব বিষয়ে প্রতিকার পেতে হলে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের ভালো-মন্দ বুঝতে হবে। মা-বাবাকে সতর্ক হতে হবে। সন্তানের ছোটখাটো ত্র”টি তারা এড়িয়ে যান। পাশ্চাত্য দেশগুলোর নোংরা কালচারে ছেয়ে গেছে আমাদের চারপাশ। ওয়েস্টার্ন কালচারের বলি হয়েছে আমাদের নারীসমাজ।
অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে ক্ষত-বিক্ষত করছে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠ, পোশাকের শালীনতা, শালীন ও মার্জিত সংস্কৃতির চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান