ভিসি বিতর্ক ও আত্মম্ভরিতার উপাখ্যান
কাকন রেজা
বিতর্ক হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আরেফিন সিদ্দিককে নিয়ে। বিতর্কটা আরও উস্কে দিয়েছে দেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠান। ‘এক্সট্রা আওয়ার’ নামের এই অনুষ্ঠানের একটি পর্বের শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ‘আ.আ.ম.স ঠঈ!’, যা ছিল মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস ‘চ্যান্সেলর নিয়োগ বিতর্ক’ বিষয়ে। অনুষ্ঠানের এমন ‘শিরোনাম’ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন অনেকেই, গণমাধ্যমে খবরও হয়েছে, সামাজিকমাধ্যমে বিতর্কও চলছে। ‘শিরোনাম’টিকে কেউ কেউ শিষ্টাচার বহির্ভূতও বলছেন।
নামকরণের বিষয়টি নিয়ে পরে বলি। আগে বলে নিই সাংবাদিকতার ‘শিষ্টাচার’ নিয়ে। যারা লিখেন কিংবা বলেন, সে যেকোনো বিষয়ে, তাদের প্রথমে নিজ ভাষা সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা থাকতে হবে। যেমনÑ বাংলা ভাষায় সম্বোধনের ক্ষেত্রে তিনটি শব্দ রয়েছে, আপনি, তুমি আর তুই। অবস্থান ও সম্মান, বয়স ও সম্পর্কভেদে এই শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। অথচ ইংরেজিতে এই ঝামেলাটা নেই, সব সম্পর্কই ‘তুমি’তে সীমাবদ্ধ। সেখানে ইংরেজিতে ‘ট্রাম্প বলে’ এমনটার বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে ‘শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া বলেছে’ এমনটা শোভন নয়, আর সেজন্যই ‘বলেছেন’ লেখা হয়। কিন্তু এই অবস্থান ভেদের বিষয়টিই গুলিয়ে ফেলেন আমাদের মাধ্যম জগতের অনেক ‘প-িত’গণ। আগেই বলে নিয়েছি ইংরেজি ও বাংলার সম্বোধনের ব্যাপারটি। সঙ্গে রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যও। সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পার্থক্যটিও সেই সঙ্গে মাথায় রাখা জরুরি। এটা না বুঝে পা-িত্য ফলানোর বিষয়টিও ভাবনার দাবি রাখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আরেফিন সিদ্দিক, পুরো নামটি কিন্তু বলা হলো না, কিন্তু তারপরেও কতটুকু বললে তা ভদ্রতাসূচক হয় তা বুঝে নিতে হয়। আর এখানেই কমনসেন্সের ব্যাপার। আর এই কমনসেন্স কাজে খাটাতে হয় নিজেদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিম-লের আবহ বুঝে। এমনকি বিবিসির মতো গণমাধ্যমও পুরো নামটি না বললেও বলবে ‘মি. সিদ্দিক’। এটাই ভব্যতা, সাংবাদিকতা কোনো অভব্য বিষয় নয়। অনেকে অবশ্য বিষয়টিকে ‘স্যাটায়ার’ আখ্যা দিতে চাচ্ছেন, তবে তারা বোধহয় স্যাটায়ারের ‘টার্ম অ্যান্ড কন্ডিশন’টা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। আরেফিন সিদ্দিক আজীবন আওয়ামী লীগের সদস্য কিনা এমন বিষয়ে স্যাটায়ারের ব্যবহারবিধিও হয়তো তারা ভুলে বসেছেন। যার ফলে পুরো ব্যাপারটাই হয়ে উঠেছে বিস্ময়কর ও প্রশ্নবোধক। অবশ্য ‘প্রশ্নবোধক’ হয়ে আলোচনায় থাকতে অনেকেরই ভালো লাগে। সে যাহোক, ভিসি আরেফিন সিদ্দিক যদি আজীবন আওয়ামী লীগার হিসেবে বিশেষিত হন, তাহলে যারা সাংবাদিকতায় আছেন তাদের অনেকেই তো বিশেষণের সে দৌড়ে তাকে হারিয়ে দেবার যোগ্যতা রাখেন। অথচ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এমনটা হওয়া অন্যায়, সর্বোপরি পেশাগত অযোগ্যতার সামিল।
সবকিছুতেই স্থান-কাল-পাত্র ভেদটি বোঝা জরুরি। রানা প্লাজার ঘটনায় ‘আপনার অনুভূতি কী’ এমন একটি প্রশ্ন যে কারণে উচ্চমার্গের ‘ট্রলে’র অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে দুর্যোগে নিপতিত হাওরবাসীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে। গত ঈদুল ফিতরে ওই চ্যানেলটিতেই সম্ভবত ‘হাওরের আনন্দ’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে। প্রশংসাযোগ্য চমৎকার অনুষ্ঠান। কিন্তু প্রশংসা করতে গিয়েই বিপত্তি। হাওরের বিপর্যয়ের কথা সকলেই জানেন। ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে একটি জনপদ, যেখানে ঘরে ঘরে চলছে হাহাকার। সচ্ছল মানুষদেরও ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে চাল নিতে হচ্ছে। ঘরে লজ্জা নিবারণের কাপড়ের যোগান যেখানে দেওয়া যাচ্ছে না, ঠিক সেই সময়ে ওই জনপদে ‘আনন্দ’ আবিষ্কার করাটা সত্যিই বিস্ময়কর।
প্রতিটি মানুষেই রয়েছে দোষগুণের সমন্বয়। ভিসি আরেফিন সিদ্দিকেরও যেমন দোষ রয়েছে, তেমনি রয়েছে গুণও। তাঁর এসব দোষগুণ আলোচনার বিষয় হতে পারে, পরিহাসের বা অসম্মানের নয়। তার রাজনৈতিক আনুগত্য দোষের হতে পারে, কিন্তু সেশনজট দূর করার কর্মযজ্ঞটি গুণের। দোষ সমালোচিত হলে, গুণও আলোচিত হবে। আর দুটোই হবে সমুচিত সম্মানের সঙ্গে।
স¤্রাট হুমায়ূনের চিরশত্রু শেরশাহ তার পুত্রদেরকে বলেছিলেন, ‘ স¤্রাট হুমায়ূন এমন একজন শত্রু যাকে সম্মান করা যায়, শ্রদ্ধা করা যায়।’ শ্রদ্ধাবোধের এ ব্যাপারটি যতদিন উপলব্ধির বাইরে থেকে যাবে, ততদিন আমরা বিনয়ের ‘সাফল্যগাঁথা’ পাব না, পাব উদ্ধত আত্মম্ভরিতার ‘চটুল উপাখ্যান’। পাব উপলব্ধিহীন ‘আত্মা’র যাতনাময় এক ‘বাড়তি সময়’।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান