৫৪ ধারার অপপ্রয়োগ আর নয়
কোনো ব্যক্তি আমলযোগ্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হলে পুলিশ তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা পরোয়ানা ব্যতিরেকে গ্রেফতার করতে পারে। এ বিধান অনুযায়ী একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এজাহার বা নালিশি দরখাস্তের মাধ্যমে মামলা দায়েরের পরই কেবল পুলিশ গ্রেফতার সংক্রান্ত ক্ষমতাটি প্রয়োগ করতে পারে। উপরোক্ত ক্ষমতাটির বাইরে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় ০৯(নয়) ধরনের কারণের উদ্ভব ঘটলে পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা পরোয়ানা ব্যতিরেকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এখানে পুলিশের গ্রেফতারের ক্ষমতাটি মুখ্য, ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে মামলা আছে কি নেই সেটি গৌণ।
৫৪ ধারায় পুলিশকে প্রদত্ত এ ক্ষমতাটি ব্যাপক হলেও অসীম নয়। পুলিশের এ ক্ষমতাটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা যুক্তিসঙ্গত তথ্য নির্ভর হতে হবে। ৫৪ ধারাটি চেতনাগত দিক হতে একজন পুলিশ কর্মকর্তার স্বেচ্ছাধীন বা স্বেচ্ছাচারি ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশে প্রয়োগ অনুমোদন না করলেও বিগত দুযুগেরও অধিক সময় ধরে এ ধারাটির যে অপপ্রয়োগ হচ্ছে সে প্রশ্নে কোনো বিতর্ক নেই।
পুলিশ একজন অপরাধী বা সন্দিগ্ধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার পরবর্তী যাত্রার সময় ব্যতিরেকে ২৪ ঘণ্টার অধিক নিজ হেফাজতে রাখার জন্য সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়শই দেখা যায় সংবিধান ও আইনকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক পুলিশ গ্রেফতারের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ না করে দীর্ঘদিন এরূপ ব্যক্তিকে নিজ হেফাজতে রেখে দেয়।
পুলিশ শৃঙ্খলাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। পুলিশবাহিনীর একজন সদস্যকে কর্তব্যরত থাকাবস্থায় নির্ধারিত পোশাক পরিধান করতে হয়। পুলিশ যেকোনো অপরাধী বা সন্দিগ্ধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার সংশ্লেষে যখন অভিযান পরিচালনা করে তখন কর্তব্যরত অবস্থা হতে তা করা হয়। এরূপ কর্তব্যরত অবস্থায় পুলিশের পোশাকবিহীন অবস্থায় অভিযান পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই।
আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে বিশিষ্ট কতিপয় ব্যক্তিসহ অনেককে পুলিশ বা বিশেষ বাহিনী পরিচয়ে গ্রেফতার পরবর্তী তাদের আর হদিস পাওয়া যায়নি। এ সকল গ্রেফতারের ঘটনা যারা সংগঠিত করেছিল তারা সকলেই সাদা পোশাকধারী ছিল এবং গ্রেফতারকালীন তারা এত বেপরোয়া ছিল যে ভুক্তভোগী বা তার পরিবারের সদস্যদের তাদের পরিচয়পত্র দেখানো বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন বাড়তি বিপদের ভয়ে স্তিমিত হয়ে যেত।
পুলিশবাহিনীর অনেক সদস্যকে দেখা যায়, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বেপরোয়া। এদের উপর ঊর্ধ্বতনের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ তেমন একটা ফলপ্রসূ ও কার্যকর নয়। শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত যেকোনো বাহিনীতে এ ধরনের ব্যক্তির উপস্থিতি বাহিনীটির সার্বিক কর্মকা-ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ ধরনের বিরূপ প্রভাবের কারণেই দেখা গেল ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে রুবেল নামক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের পুলিশকর্তৃক ৫৪ ধারায় গ্রেফতার পরবর্তী তাদের হেফাজতে থাকাকালীন মৃত্যু ঘটলে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ঘটনা সংশ্লেষে ব্ল্যাস্ট নামক একটি মানবাধিকার সংগঠন রিট মামলা করলে হাইকোর্ট বিভাগ হতে গ্রেফতার বিষয়ে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে সরকার কর্তৃক ৫৪ ধারা সংশোধন সাপেক্ষে নির্দেশনাসমূহ প্রতিপালন করতে বলা হয়। নির্দেশনা প্রদান পরবর্তী এতদবিষয়ে আপিল বিভাগে আপিল করা হলেও আপিল আদালত হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের উপর কোনো স্থগিতাদেশ না দেওয়ায় নির্দেশনাসমূহ রায় প্রদান পরবর্তী প্রতিপালন অত্যাবশ্যক ছিল। গ্রেফতার সংশ্লেষে যে নির্দেশনা ছিল তা হলোÑ (ক) গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে, (খ) গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে উল্লেখ করবে, (গ) গ্রেফতারকৃতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিতে হবে এবং পুলিশ ডাক্তারি সনদ সংগ্রহ করবে, (ঘ) গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে এর কারণ জানাতে হবে, (ঙ) বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান হতে গ্রেফতার হলে তার নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তা বাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে এবং (চ) গ্রেফতারকৃতকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
সরকারের আপিলটি আপিল বিভাগ হতে গত ২৪ মে, ২০১৬ খ্রি. খারিজ হয়ে গেলে উপরোক্ত নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়ন যে একান্ত অপরিহার্য সে প্রশ্নে এখন আর কোনো বিতর্ক নেই। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, দীর্ঘদিন যাবৎ পুলিশ সাদা পোশাকে পরিচয়পত্র দেখানো ব্যতিরেকে হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার অবজ্ঞায় ও উপেক্ষায় গ্রেফতারের কার্যক্রম অব্যাহত রাখায় অনেক হৃদয়বিদারক, দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম হয়েছে যা কোনোভাবেই গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আইন মেনে চলা দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত আইনের সমরূপ। আর তাই ৫৪ ধারার অপপ্রয়োগের পথ যে একেবারেই রুদ্ধ সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের বোধদ্বয় হবে কী?
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
রশঃবফবৎধযসবফ@ুধযড়ড়.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান