ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে
এস এম নূর মোহাম্মদ : আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেছেন, প্রধান বিচারপতি যদি বলেন, পার্লামেন্ট ইমম্যাচিউর তা হলে তো আমাকেও বলতে হয় সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিরা ইমম্যাচিউর। পরস্পর একে অপরকে যদি আমরা সম্মান করতে না শিখি তাহলে যারা বলছেন, তারা নিজেরাইতো নিজেদের ইমম্যাচিউর প্রমাণ করছেন। এই রায়ের পর আমাদের মনে হচ্ছে, জাজেস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। তাই তার মতে রায়ে মূল বিষয় বাদ দিয়ে বেশি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাই মূল বিষয়টাই হারিয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি।
গতকাল বুধবার আইন কমিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে আইন কমিশনের পক্ষ থেকে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এই সময় তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত পাতার পর পাতা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যার কোনো দরকারই ছিল না। যা কেবল কলেবর বৃদ্ধি করার জন্য করা হয়েছে। এখানে হাইকোর্টের রায়ের ওপর সামান্যই আলোচনা করা হয়েছে। রায় পড়ার শুরুতে সাত পৃষ্ঠা পর্যন্ত তিনি বুঝতেই পারছিলেন না কোন বিষয়ে এখানে বলা হয়েছে। শুরুতে এটি লরিম্যানের অটো বায়োগ্রাফির মতো মনে হচ্ছিল।
খায়রুল হক বলেন, কেউই সমালোচনরার ঊর্ধ্বে নয়। রায় হয়ে গেলে সবাই এ সম্পর্কে কথা বলতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট একটি প্রতিষ্ঠান। জনগণের টাকায়ই এটি চলে। তাই যে কোনো ব্যক্তিই রায় নিয়ে কথা বলতে পারেন।
তিনি বলেন, সংসদ এবং ইলেকশন কমিশন সম্পর্কেও রায়ে অনেক মন্তব্য করা হয়েছে। অথচ তারা এ মামলার পক্ষ ছিল না। যাদের পক্ষ করা হয়নি, তাদের অবর্তমানে এ ধরনের মন্তব্য করা বাঞ্ছনীয় নয়। রায়ে পার্লামেন্টকে ইমম্যাচিউর (অপরিপক্ক) বলে ক্রিটিসাইজ (সমালোচনা) করা হয়েছে। এটাতো উচিত নয়।
খায়রুল হক বলেন, রায়ে বলা হয়েছে এমপি হওয়ার আগে তাদের কনসিডার করা উচিত তারা এমপি হওয়ার যোগ্য কি না। এটা ভোটাররা দেখবে। সুপ্রিম কোর্টের তো এ বিষয়ে বলার কথা না। যদি এখন উল্টো করে এমপিরা বলে হাইকোর্টের জাজরা জাজ হওয়ার যোগ্য কি না, এটা কি তারা বিবেচনা করে দেখেছেন? তাই এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক কথা উচিত না।
তিনি আরও বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি এ রায় হওয়ার আগে থেকে অনেক বিচারপতি এমপিদের বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনারে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এতে মনে হয় অনেক আগে থেকেই এ রায়ের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা ছিল। বলা হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে না। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছাড়াই এতকাল বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল। এর আগে ৯৬ অনুচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল। আসলে স্বাধীন বিচার বিভাগের সঙ্গে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সম্পর্ক নেই।
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, সবার যেহেতু সংসদের কাছে জবাবদিহিতা আছে, বিচারকদের তো সেটা না থাকার কথা ছিল না। যখন ৯৬ অনুচ্ছেদকে অবৈধ ঘোষণা করা হলো তাহলে সেই জবাবদিহিতা রইল কোথায়? আমরা এতকাল জেনে এসেছি, পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। কিন্তু এই রায়ের পর আমাদের মনে হচ্ছে, জাজেস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। উনারা বলছেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের জন্য বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে গেছে। কালকে তো অন্য আরেকজন এসে রিট ফাইল করতে পারে যে, আমাদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকা চলবে না?
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের পর থেকে আমাদের বিচারকরা স্বাধীন ছিলেন না, এরকম কথা কেউ বলেননি। মার্শাল ল’ পিরিয়ড ছাড়া কখনো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে বলে দেখিনি। খবরের কাগজে দেখলাম, সুপ্রিম কোর্ট থেকে দুদককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, সাবেক একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত না করতে। এখানেই তো দেখা যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে। এতে শুধু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলই নয়, জুডিশিয়ারির ওপরই আমাদের ফেইথ একটু টলমল হয়ে গেছে। এতেই প্রমাণ হয় জজ সাহেবরা মুখে যতই বলুক তারা পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে নন। নইলে দুদককে তারা কিভাবে সুপ্রিম কোর্ট থেকে চিঠি লিখতে পারে?
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, রায়ে ঘোষণা করা হলো ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ। বিষয়টি নিয়ে সংসদে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই কিভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বৈঠক করল? করতে পারত যদি সেটি মূল সংবিধানের অংশ হতো। অরিজিনাল হলে অটোমেটিক সেটা প্রতিস্থাপন হতো। এই হলো প্রথম মামলা, যেখানে অরিজিনালকে বাদ দিয়ে মার্শাল ল’ প্রভিশনকে সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করেছে। এই প্রথমবার অরিজিনালকে সংসদ আনতে চেয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট দেয়নি।
তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগ ভুল করলে সুপ্রিম কোর্ট সংশোধন করে দেয়, সংসদ ভুল আইন করলে সুপ্রিম কোর্ট সেটা বাতিল করে দেয়। আমাদের ভয় হয়, সুপ্রিম কোর্ট যদি ভুল করে তাহলে আমরা কোথায় যাব? সম্পাদনা : হাসান আরিফ