বিএনপি পরিপক্ক রাজনৈতিক দল হয়ে উঠছে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থেকে বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল। তাদের এই সিদ্ধান্তটি কি সঠিক, নাকি ভুল ছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করতে চেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠন করার জন্য, এটা বিএনপির নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষা কিংবা কৌশল। কিন্তু বিএনপির ওই প্রতিবাদ, আন্দোলন কোনো কাজে আসেনি। তারা সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি। তার ফলে আওয়ামী লীগ নিজেদের অধীনেই একতরফাভাবে নির্বাচনটি করে। এবং ক্ষমতায়ও পূর্ণ মেয়াদে থেকে গেল। বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, না করা নিয়ে এখনো আলোচনা হয়। সেটা সাধারণ মানুষ থেকে সুশীলসমাজ, এমনকি রাজনীতিবিদদের মধ্যেও। আমার ধারণা, এ নিয়ে বিতর্কটা অব্যাহত থাকবে বহু বছর ধরে। তবে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রণ না করাটা ভুল না সঠিক তা ইতিহাসই মূল্যায়ন করবে।
বিএনপিকে নিয়ে যা বলতে পারি তা হলোÑ বিএনপি আগের মতো রাজনীতির মাঠে সক্রিয় নেই। তারা এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। বিএনপির এখন আর কিছু নেই, দল হিসেবে প্রায় হারিয়ে গেছে। এই কথাগুলো যদি ইতিহাসে প্রমাণ হয় যে, বিএনপি নিষ্ক্রিয় ছিল, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে দল হিসেবে বিএনপি হারিয়ে গিয়েছিল, প্রায় শেষ হয়ে গেছে তখনই মনে হবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি ভুল করেছে। একদিকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করল না, অন্যদিকে আন্দোলনেও সফল হলো না। দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা-হামলা, গুম এবং হত্যাকা-ের শিকার হলো। এই যে এত প্রতিকূলতা বিএনপি মোকাবিলা করল বা এখনো করছে, বিএনপির প্রতিষ্ঠার পর এখনকার মতো পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে দলটি যায়নি। বিএনপি ক্ষমতার রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় থেকেই দলটি গঠিত হয়েছে।
আমরা দেখেছি, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর এরশাদ এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম দলসহ অনেক রাজনৈতিক সংগঠনই। আন্দোলনটি ছিল ঐক্যবদ্ধ, সম্মিলিতভাবে। তখন বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর ওই পরিমাণ নির্যাতন করা হয়নি, যা এখন অথবা গত কয়েক বছর ধরে যা হলো। তবে এর ইতিবাচক দিক হলো, মাঠ পর্যায়ে দলটির নেতাকর্মীরা মার খেয়ে, নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিপক্ক হয়ে উঠল। যদি সত্যিই পরিপক্ক হয়ে উঠতে পারে তাহলে সেটি বিএনপির জন্যই ইতিবাচক হবে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, আমাদের এখানে যখন যে সরকারে থাকে তখন তারা বিরোধী দলকে দুর্বল করতে চায়। ভাঙতে এবং শেষ করে দিতে চায়। বিএনপি আন্দোলনে নেই, নেই মাঠ পর্যায়ের কোনো কমসূচিতেও। কিন্তু বিএনপির শক্তি, ভোট এবং বিএনপির সমর্থক যে কমে যায়নি, যখন যেখানে ভোট হয়েছে তা প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে ইতিবাচক হচ্ছেÑ বিএনপিকে অনেকবার, অনেক রকমভাবে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু এখনো সেটা সম্ভব হয়নি। এই যে বিএনপিকে ভাঙা সম্ভব হলো না সেটাও রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিপক্ক হয়ে ওঠার একটা ইঙ্গিত দেয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে সময়ে হওয়ার কথা, আনুষ্ঠানিক সব প্রস্তুতি যদি সম্পন্ন থাকে তাহলে নির্বাচন সঠিক সময়েই হবে। আমার ধারণা, রাজনীতির হিসাব যা বলে তাতে বিএনপি সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। তাদের সহায়ক সরকারের দাবি থাকবে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারবিরোধী আন্দোলনও থাকবে। তবে বিএনপি কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বা কতটুকু তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এবং আন্দোলনের মাধ্যমে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে বলে মনে হয় না। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কারণ তারা জানে যে, তাদের প্রচুর জনসমর্থন রয়েছে। জনসমর্থনকে কাজে লাগিয়ে ভোটারদের পক্ষে টানার বা ভোটাররা যেন নির্বাচন কেন্দ্রে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারে সে রকম একটা পরিবেশে সৃষ্টি করতে চাইবে। এটা বিএনপি একা কতটুকু করতে পারবে, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক রাজনীতি বাংলাদেশকে নিয়ে নির্বাচনের সময় কীভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, নির্বাচনে তাদের চাপ বা তাদের উপস্থিতি কতটুকু থাকবে সেই বিষয়গুলো নির্ভর করবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরবর্তী ফলাফলে উপর।
একটা প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছেÑ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি মতোই আরেকটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে? এমন একটা শঙ্কা মানুষের মধ্যে থাকলেও আশার কথা হচ্ছে, একই ঘটনা রাজনীতিতে সাধারণত পরপর দুবার ঘটে না। এবার কি ঘটবে জানি না। তবে আমার ধারণা, ৫ জানুয়ারিতে যে ঘটনা ঘটেছিল তার হুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। ভোটারবিহীন নির্বাচনের যে রেওয়াজ, সেটা পুরোপুরিভাবে করা এবার সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এবার মানুষ যেন ভোট দিতে পারে তার ব্যবস্থা করাই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। এবং সেটা কীভাবে হবে বা কোন ফরমেটে হবে, কারা পর্যবেক্ষণে থাকবে বা কারা এখানে প্রভাব তৈরি করবে সে বিষয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না। সামনের সময়ে আরও অনেক ঘটনা ঘটবে।
পরিচিতি: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
মতামত গ্রহণ: বায়েজিদ হোসাইন/সম্পাদনা: আশিক রহমান