তরুণদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ কি আকাশ সংস্কৃতি?
অপরাধ প্রবণতা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়ে সমাজের সর্বত্র মহামারি আকার ধারণ করেছে তাতে মনে হচ্ছে যে, জনসংখ্যার মূলস্রোতের একটি বড় অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। অপরাধের ধরন এবং পদ্ধতি দিন দিন আপ-গ্রেডেড হচ্ছে। অপরাধ দমনের আইন যেমন দিনদিন কঠিন হচ্ছে ঠিক তেমনি অপরাধ করার প্রবণতা ও পদ্ধতি পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বায়ুপথে বাতাস ঠুকিয়ে হত্যা করার কাহিনী ইতোপূর্বে শোনা যায়নি। কিন্তু বছর ২/১ এর মধ্যে এ ধরনের কয়েকটি কা- ঘটে গেল যা এখন হত্যার একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। দ-বিধি আইন প্রণীত হয় ১৮৬০ সালে যাতে অপরাধের সঙ্গেও শাস্তির বিধান সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অপরাধের ক্যাটাগরিকে আরও সুনির্দিষ্ট করে সময়ে সময়ে স্পেশাল ল (ঝঢ়বপরধষ খধ)ি প্রণয়ন করা হয়েছে এবং আদালতের প্রকার ভেদে বিচারব্যবস্থার বিধান রাখা হয়। ১৮৬০ সালে প্রণীত দ- বিধিতে ৫১১টি অপরাধের সঙ্গেও শাস্তি উল্লেখ রয়েছে, এমনকি টহ-ঘধঃঁৎধষ ঙভভবহপব-এর শান্তির কথাও দ-বিধি ৩৭৭ ধারায় উল্লেখিত রয়েছে। কিন্তু বায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা অপরাধ সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্টভাবে দ-বিধি বা পরবর্তীতে প্রণীত কোনো আইনে উল্লেখ নেই। অর্থাৎ আইন প্রণেতাদের মাথায় যে অপরাধ ধরনের কথা খেয়ালে আসেনি সে অপরাধ এখন সংগঠিত হচ্ছে। এ জন্য পুলিশি ঝামেলা বা খুনের অপরাধে দ-িত হওয়ার কথা জেনেও অপরাধের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
বার্থ ডে পার্টিতে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে ধর্ষণের ক্ষেত্রে (অর্থাৎ ধর্ষণ জগতে) এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। যে সব মেয়েরা হোটেলে বার্থ ডে পার্টি করতে গিয়ে রাত্রিযাপনে ধর্ষিতা হয় তাদের বা তাদের অভিভাবকদের কি এ মর্মে কোনো দায়িত্ব জ্ঞান নেই? নিজেকে ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটু সচেতনা কি কারও বিবেককে ধাক্কা দেয় না? ‘ইুঁবৎ জবংঢ়ড়ংরনরষরঃু’ বলতে ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি আইনগত কথা (খবমধষ ঞবৎস) রয়েছে। যাচাই-বাছাই ও পরখ করে মালামাল ক্রয় করা ক্রেতার দায়িত্ব। হোটেলে দাওয়াত গ্রহণ এর জবংঢ়ড়ংরনরষরঃু অর্থাৎ দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে যারা ঠরপঃরস বা তাদের অভিবাবকরা কেন উদাসীন? এটা কি আধুনিকতার প্রভাব না নৈতিকতার অভাব? শুধুমাত্র কি আইন প্রণয়ন করে অপরাধ দমন করা যাবে? থানার, পুলিশ সংখ্যা, ক্ষমতা, আধুনিকায়তন সবই তো জ্যামেতিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা শহরে গত ৫ বৎসরে থানার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে তারপরও অপরাধের সংখ্যা বিশেষ করে অনৈতিক অপরাধ যা কুরআন শরিফের ভাষায় অশ্লীলতাও জ্যামেতিকহারেই পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? এ বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার এবং এজন্য শুধু পাবলিসিটির জন্য নয়। বরং সমস্যা সমাধানের জন্য বিষয়টির উপর মনোনিবেশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়া একটি ছেলে একজন মেয়েকে নিয়ে হোটেলে ঢুকবে, দরজা বন্ধ করে নাচানাচি করবে, মদ্যপান করবে এতে কোনো অপরাধ হবে না বরং তাকে ধর্ষণ করা মাত্রই থানা, পুলিশ, কোর্ট-কাচারি এসে উপস্থিত হবে এটা কি কোনো যুক্তি সমর্থন করে? ধর্ষণের সূচনা যেখানে সেই পথরুদ্ধ করতে হবে।
রাতের অন্ধকারে গভীর জঙ্গলে একাকি অবস্থায় একজন নারীকে একজন লোলুপ দৃষ্টি পুরুষের হাত থেকে বাঁচানোর একমাত্র অস্ত্র নৈতিকতা, কিন্তু সে নৈতিক শিক্ষাই এখন অনুপস্থিত। নিরস্ত্র মানুষের উপর বোমা নিক্ষেপ বা ভিন্ন ধর্মের মানুষকে হত্যা বা কোনো কারণেই বিচার বহির্ভূত হত্যা জিহাদ নয়। নিজের পাশবিকতার বিরুদ্ধে নৈতিকতার বিজয়ই শ্রেষ্ঠ জিহাদ। তাই শ্রেষ্ঠ জিহাদ অর্জন করতে হলে নিজের অপশক্তির বিরুদ্ধে নিজেকে জিহাদ করতে হবে ন্যায় ও নৈতিকতার পক্ষে। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়?
এখন ডিজিটাল যুগ। ডিজিটালের প্রভাবে তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত। এ মাধ্যমগুলো কি নৈতিকতা শিক্ষা দিচ্ছে, নাকি যুব সমাজকে বিপরীত দিকে ধাবমান করছে? রেইনট্রি হোটেলের ঘটনার পর ধর্ষকের পিতা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেন সেলিমের মিডিয়াতে দেওয়া বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, অর্থের বিনিময়ে তারা ‘আধুনিকতা’ বরণ করেছে নৈতিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে। আকাশ সংস্কৃতি কি নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেয়? না। না দেওয়ার কারণ তাদের ব্যবসা। হিরোইন, ফেন্সিডিল, ইয়াবা, মদ, গাঁজা প্রভৃতি মাদক যেমন প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, অন্যদিকে এ ধ্বংসলীলাকে এক ধাপ এগিয়ে নিচ্ছে আমাদের আকাশ সংস্কৃতি।
লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক সিনেটর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সম্পাদনা: আশিক রহমান