প্রযুক্তি যত উন্নত, নৈতিকতায় তত ধস
সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে কতিপয় মানবিকবোধহীন মানুষরূপী পশুর বর্বরতায়। অপেক্ষার দিন আর নেই। এখনই অপরাধীর প্রকাশ্য মৃত্যু-র আইন দরকার। জাগ্রত বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে পারে নাÑ কোথায় আছি আমরা? বর্বরতার জঘন্যতা লালন করা কি কতিপয় পুরুষের নেশা হয়ে উঠেছে? কোথায় সেই নৈতিকবোধের ধারণা, যা বিবেককে জাগ্রত রাখে?
ধর্ষিতরা আর কেউই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। থাকে ভীতসন্ত্রস্ত। ঘুমাতে পারেন না, লজ্জায় ঘরের বাইরে যেতে পারেন না। অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারেন না। নির্যাতনের শিকার নারীকে তার পরিবার বোঝা মনে করেন। থানা, হাসপাতাল ও আদালতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করে না। ঘটনার জন্য তাকেই দায়ী করে নানা ধরনের মন্তব্য করে। যেমন, থানায় মামলা করতে গেলেÑ ‘মেয়েরা আসলেই খারাপ। একটা ছেলে দৈহিক মেলামেশা করতে চাইতেই পারে কিন্তু মেয়েরা সহজেই মেলামেশায় লিপ্ত হয়। বিয়ে করতে না চাইলে ধর্ষণের মামলা করে।’ হাসপাতালে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার সময়ে- ‘বেহায়া মেয়ে, আগেই শরীর পাইতা দেয়’… ইত্যাদি বিভিন্ন মন্তব্য করে। আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণকালে আসামি পক্ষের আইনজীবী সহিংসতার শিকার নারীকে ‘খারাপ মেয়ে’ বা ‘দেহব্যবসায়ী’ হিসেবে প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকে। সহিংসতার শিকার নারীকে মামলা চালনার জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োজিত আইনজীবীকেও (পিপি) প্রতি হাজিরাতে টাকা দিতে হয়। এতে সহিংসতার শিকার নারী ও তার পরিবার মানসিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সমাজ থেকে ধর্ষণ দূর করতে হলে প্রথমত যে কাজটি করতে হবে তা হলোÑ ধর্ষক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহযোগিতা যাতে না পায় এর ব্যবস্থা করা। বিত্তবানদের অনেকের ছেলে ধর্ষণ করার সুযোগটি পাচ্ছে বিত্তবান হওয়ার কারণে। তারা একটি বলয় তৈরি করে নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতারা ধর্ষকের পক্ষে দাঁড়িয়ে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ন্যায়বিচার পাইয়ে না দিয়ে মিলমিশ করানোর চেষ্টা করে। ধর্ষণের মামলা আপসযোগ্য নয়, এরপরও ধর্ষণের মামলায় আপস হতে বাধ্য হয় ভুক্তভোগিরা। সমাজের উঁচু মাথার এই মানুষদের চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন দরকার। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, কতিপয় আপনহারা বাঁধনহারা অনিয়ন্ত্রণ নারী, মাদক সেবন বৃদ্ধি, অসাধু বিত্তবানদের ক্ষমতায়ন, ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির ব্যাপক প্রসার এবং বিকৃত রুচির মানসিকতা ইত্যাদি কারণে ধর্ষণের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। কারণ অধিকাংশ ঘটনাই নিজেদের অসচেতনতার কারণে ঘটে। এজন্য অভিভাবককে খেয়াল রাখতে হবে সন্তান যাতে কোনো বিপদের সম্মুখীন না হয়। কারণ ধর্ষণকারী সুযোগ ও পরিবেশ খোঁজে। ধর্ষণকারীকে সেই সুযোগটি দেওয়া যাবে না। দেশে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বাড়ছে। কালো টাকার দৌরাত্ম্য শক্তিশালী হচ্ছে। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নে রাজনীতি দিনে দিনে যত পেশীনির্ভর, কালো টাকা নির্ভর হচ্ছে ততই নানা অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। মাদকের মতো ধর্ষণকেও না বলতে হবে। পার্লামেন্টে ‘জিরো টলারেন্স টু রেইপ’ এ মর্মে প্রস্তাব পাস করা যেতে পারে। ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাগুলোতে বিশেষভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও ইতিবাচক ভূমিকা একান্ত প্রয়োজন। অথচ প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নিতে গিয়ে প্রায় সময়েই তথাকথিত ওপর মহলের চাপের সমস্যার কথা বলেন। এ উপর মহলের অর্থ হতে পারে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি, হতে পারে দলীয় স্বার্থ, হতে পারে রাজনৈতিক খেলার প্রক্রিয়া, বিত্তবান কিংবা সমাজের উচ্চ শ্রেণির চাপ। উপর মহলের চাপের সমস্যা যতদিন দূর না হবে, বন্ধ না করা যাবে ততদিন মেয়েরা নিরাপদ জীবন পাবে না।
ধর্ষণ মামলায় আইনের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এছাড়া সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় থাকায় ধর্ষণকারীরা ভয় পাচ্ছে না। কারণ তারা এ রকম জঘন্য অপরাধ করেও ভাবে তাদের কিছু হবে না। সন্তান বাবা-মায়ের কাছ থেকে নৈতিকতার শিক্ষা নেয়। আধুনিক যুগের অভিভাবক তার ১৪/১৫ বছরের ছেলে অথবা মেয়ের হাতে দামি মোবাইল সেট তুলে দেয়। মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেটে তারা পর্নোগ্রাফি দেখছে সে খবর অভিভাবক রাখেন কি? যত প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে সমাজে তত নৈতিকতা কমছে। তরুণদের মধ্যে নৈতিকতার শিক্ষা পরিবার থেকে দিতে হবে। তাদেরকে ছেলেবেলা থেকে ভালো ভালো বই পড়াতে হবে। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের দিকে এগিয়ে দিতে হবে। এতেই সমাজ থেকে ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো দূর হতে পারে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান