পড়াশুনা করতে,কেহ পড়ে সায়েন্স আর কেহ নেয় অনার্স
ওসমান্ড রড্রিগ্স্
মানুষ জন্ম লগ্ন হতেই শিক্ষা লাভ করতে থাকে এবং তার মগজে জ্ঞান অর্জিত হতে থাকে। যার আই কিউ ভাল সে তাড়াতাড়ি শেখে এবং বুঝে এবং যার মগজ গঠন শক্ত নয় তার সবকিছুই দেরীতে হয় এবং এমন কিছু আছে যা তার মাথায় ধরেই না। তাই মানুষ কেউ চালাক ও কেউ বোকা (সরল)। তাই পড়াশুনা করতে কেহ পড়ে সায়েন্স আর কেহ নেয় অনারস্। কেহ হয় কামার, কুমার, জেলে আর কেহ হয় অফিসার, শিক্ষক,বিজ্ঞানী বা আইনজ্ঞ। মেধা অনুযায়ী বিষয় পড়াশুনা বা কাজ শেখা প্রয়োজন। যিনি স্বর্ণের কাজ করেন তিনি হালচাষ বা মাটির কাজ কাটা করতে পারবেন না। যিনি শিক্ষক তিনি বাস চালাতে বা কাপড় শেলাতে পারবেন না। পারলেও ভাল হবে না বা কঠিন ঠ্যাকায় না পারলে তিনি তা করবেন না। সব বিদ্যা সবার সাজে না। সাপ্তাহিক প্রতিবেশীতে বিদ্যা, শিক্ষা ইত্যদি নিয়ে আমার অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। তারপরও বলেছিলাম শিক্ষা নিয়ে আরো লিখবো। ছোট বেলায় যখন স্কুলে (বেবী ক্লাশে) যেতাম তখন থাকতো একটা স্লেট ও একটা পেন্সিল মাত্র (কাঠ পেন্সিল নয়)। আর বর্তমানে সেখানে বাচ্চা ভার বইতে পারে না এমনই বই খাতা তাকে বহন করে নিতে যেতে হয় স্কুলে। ঠিক আছে, কেন না লেখাপড়া আর আগের মত নেই। বর্তমানে অত্যাধুনীক লেখাপড়া। আমরা ক্লাশ থ্রিতে যা পড়া শিখতাম তা বর্তমানে ক্লাশ ওয়ানেই শেখানো হয়। তখনকার দিনে কেহবা ছয়/সাত বছরে ক্লাশ ওয়ানে পড়তো। আর বর্তমানে সাড়ে তিন বছর হতে না হতেই মা/বাবা স্কুলে ভর্তি করানোর জন্যে পাগল হয়ে যায়। ভাবতে হবে ওর শেখার বয়েস হয়েছে কিনা বা ক্লাশ ওয়ানে ওর কঠিন পড়া মাথায় ঢুকবে কিনা। আদর স্নেহ ইত্যাদির অভাবে বা স্বস্তিতে লেখা পড়ার সুযোগের অভাবে (চাপে) ওর প্রতিভা কোনও না কোনও ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এসমস্ত কারণে ভবিষৎতে যা ফল দাঁড়াবার কথা কখনো বা সে তার ধারে কাছেও থাকে না। চাকুরীতে ঢোকার আগেই কোথায় ঘুষ খাওয়া যাবে এমনি পরিকল্পনা করতে থাকে। তখন তার মেধা বা গুণাগুণ চলে ভিন্ন খাতে বা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। বর্তমানে অভিনব পদ্ধতিতে স্কুলে পড়াশুনা করানো হয়। খ্রিস্টান মিশনারী এবং গুটি কতক স্কুলে সঠিক নিয়েমে ছাত্রদের পড়ানো হয় এবং বাকীগুলো শুধু গতকালের দেয়া বাড়ীর কাজ নেয়া ও নতুন বাড়ীর কাজ দেয়া কিন্তু পড়ায় না। পড়ায় না তা ঠিক নয়, তবে সেটা সেই একই শিক্ষকই বাসায় এসে মোটা অংকের টিউশন ফী নিয়ে পড়ায়। তাহলে পড়াশুনা হয় বাসায় অথবা কোচিং সেন্টারে। স্কুল আছে শুধু হাজিরা, অনুপস্থিত হিসাব, বেতন নেয়া, ভর্তি বানিজ্য, পরীক্ষা নেয়া, সার্টিফিকেট ও টি.সি. দেয়া ইত্যাদি করার জন্যেই। আমার মতে কোচিং সেন্টারই আসল পড়াশুনা হয়, স্কুলে নয়। বিদ্যা অর্জন স্কুল থেকে উঠেই যাচ্ছে।
আমার দাদা ১৯২৬ সালের দিকে ম্যট্রিক (বর্তমানে এস.এস.সি) পরীক্ষা দেন সেন্ট গ্রেগরীজ হাইস্কুল, লক্ষীবাজার, ঢাকা শহরে। তিনি এবং পরবর্তীতে আমার বাবাও সেন্ট গ্রেগরীজ হাই স্কুলের হোষ্টেলে থেকে পড়াশুনা করেন। দাদা বলে ছিলেন, ফাইনাল পরীক্ষার এক সপ্তাহ পূর্বেই ব্রাদার সমস্ত বই খাতা তুলে নিয়ে জেতেন। অর্থাৎ সারা বছরের পরীক্ষা দিতে হবে এবং রাতে পরে মুখ করে সকালে পরীক্ষা চলবে না। এবং সেটাই ছিল প্রকৃত পড়াশুনা। বর্তমানে বেশীরভাগ মুখস্ত বিদ্যা এবং তাই চাকুরী স্থলে দেখা যায় আগেকার দিনের অষ্টম শ্রেণী পাশ করা লোকের বিদ্যা কখনোবা বর্তমানের এস.এস.সি. পাশ করা লোকের নেই। চিঠিতে অজস্র বানান ভুল। ইংলিশে অনার্স পাস করেও ইংরেজীতে সঠিকভাবে একটি লাইনও ইংলিশে বলতে পারে না। তাহলে তার এই বিদ্যার্জনের কি মানে। অনেক ডিগ্রী নিলাম কিন্তু তা কাজে লাগাতে পারলাম না, এই বিদ্যার অর্থ কি? ডিগ্রী আছে, নেই জ্ঞান। দেশে সবাইকে দুর্গা হতে হবে, যার মানে আমি পাই না। দশ বিষয়ে (বর্তমানে আরো বেশী) সাবজেক্টে পাশ না করতে পারলে এস.এস.সি.তে ফেল এবং তার জীবন বাতিল। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষা সফরে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া হয় এবং শিক্ষকেরা খেয়ার রাখে কে কোন দিকে বেশী ঝুকছে। তারা যদি দুই বিষয়ে ফেলও করে, তাদেরকে তাদের চাহিদা, ইচ্ছামত ভিন্ন সাবজেক্ট পড়ানো হয়। এতে দেখা যায় তারা সে বিষয় গুলোতে অনেক ভাল ফল করেছে। এমনকি তারা কোনও বিশেষজ্ঞ বা বৈজ্ঞানিকও হয়েছেন। আর আমাদের দেশে সেই ছেলেটা হয়তো বাংলা ব্যাকরণ খারাপ করাতে এস.এস.সি. নামক পরীক্ষায় ফেল করে উচ্চতর পড়াশুনার ভিসা পেল না এবং এস.এস.সি ফেল নাম নিয়ে জীবন কাটালো। আমি পড়াশুনায় বরাবরই খারাপ ছিলাম। ১৯৬৮ সনে আমি অষ্টম শ্রেণীতে সেন্ট গ্রেগরীজ হাই স্কুলে পড়ি। অষ্টম শ্রেণীতেই ঠিক হবে আমি কোন গ্রুপে (সায়েন্স না আটস্) নেব। দশ বিষয়ের ৭ বিষয়েতেই আমার সায়েন্স নেবার মত নাম্বার নেই। সায়েন্স পড়া হবে না ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে ইংলিশ, বিজ্ঞান ও ভুগোলে নাম্বর অনেক। হঠাৎ হেড মাষ্টার (ব্রাদার) আমাকে ডাকালেন এবং বললেন ‘তুমি সায়েন্স পড়তে চাও?’ আমি বুঝে ওঠার আগেই ব্রাদার আমাকে বললেন, তোমার সায়েন্সে অনেক নাম্বার এবং তুমি চাইলে আমি তোমাকে সায়েন্সে দিতে পারি। আনন্দে আমি আত্মহারা হয়ে গেলাম। ব্রাদার শুধুমাত্র বিদেশী বিধায় সেদিন আমাকে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ করে দেন এবং অন্য স্কুলে হলে আমার আর সায়েন্স পড়া হতো না। তখন আমার গতি কি হতো কে জানে। ব্যপারটা ভেবে আমার এখনও খুশিতে কান্না পায়। দেশের শিক্ষক ও শিক্ষীত মহলের জন্যেই এই উপমাটা দিলাম। আমি পুরনোদিনের লোক এবং নতুন পরীক্ষা ও তার ফলাফল অতো ভাল বুঝি না। ঢাকা শহরে ধনীর ছেলে পাঁচ বিষয়ে প্রাইভেট টিউটর রেখে, গাড়ীতে চড়ে স্কুলে পড়াশুনা করে। বাসস্থান ও খাদ্যের অভাব নেই। সে জিপিএ ৫ পাবে নাতো কে পাবে? সে যাই হোক, আমি তাকে দাম দেব না। আমি দাম দেবো যে ছাত্র/ছাত্রী গ্রামে থেকে প্রাইভেট টিউটর ছাড়া সেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। কারণ তারই প্রকৃত জ্ঞান আছে এবং প্রকৃত জ্ঞান সাধন হয়েছে।