শিশু ধর্ষণ এবং আমাদের দায়
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হলে আমাদের শিশুদের সবার আগে রক্ষা করতে হবে। শিশুদেরকে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে দিনদিন শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতা খুললেই চোখে পড়ে দেশের কোনো না কোনো স্থানে শিশু নির্যাতনের খবর। যা দেখে রীতিমতো চমকে উঠতে হয়। যেটা কোনো সভ্য দেশের নাগরিক আশা করে না। আমাদের দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে শিশু নির্যাতন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেছেন দেশের বিজ্ঞমহল। সম্প্রতি ঢাকার মধ্য বাড্ডার ৩৬০, আদর্শনগরের মিনহাজের টিনশেড বাসার পাশের বাসায় সাড়ে তিন বছরের শিশু তানহা একা আন্টির সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফিরছিল। এমন সময় খাবারের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ বাথরুমে ফেলে দেয় মানুষরূপী পিশাচ শিপন (৩৫)।
১৫ জুলাই শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখীপুর থানার সখীপুর ইউনিয়নের সরদারকান্দি গ্রামের লেহাজ উদ্দিন শেখের মেয়ে ও সখীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী লিজা আক্তারকে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নির্মমভাবে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। আটদিন পর বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে ছৈয়ালকান্দি গ্রামের পাটক্ষেতের পানি থেকে লিজার গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্তের পর লিজার জরায়ু, লিভার, ফুসফুস, কিডনি ও হৃৎপি-সহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পাননি ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। এসব দেখে চিকিৎসকরাও হতবাক হয়ে যান। শুধু ঢাকা বা শরীয়তপুরে নয়, সারাদেশে প্রতিদিনই শিশুর ওপর এমন পাশবিক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ঠেকানো যাচ্ছে না শিশুর প্রতি পাশবিক সহিংসতা। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এই ৭ মাসে শিশু ধর্ষণের ৩৫২টি ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে জানুয়ারিতে ৪১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫০, মার্চে ৫৩, এপ্রিলে ৫৬, মেতে ৭৭, জুনে ৪৩ ও জুলাইয়ে ৩২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৬ সালে শিশু ধর্ষণের শিকার হয় ৬০১ জন। ২০১৫ সালে ৫২১ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯, ২০১৩ সালে ১৭০ এবং ২০১২ সালে ৮৬ জন।
পরিসংখ্যান বলে দেয় উদ্বেগজনকহারেই শিশু ধর্ষণ বাড়ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রমতে জানা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৩ মাসে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ১৩ হাজার ৬৬৬টি, তদন্তাধীন মূলতবি মামলার সংখ্যা ১ হাজার ২৬৫টি। ৩১৮ মামলায় ৪৯১ আসামি খালাস পেয়েছে। অন্যদিকে ৫১টি মামলায় ৭০ আসামির বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে ৭৫৪ মামলায় ১ হাজার ১২৩ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। ১৯৮টি মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। অর্থাৎ ১৯৮ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। পরিসংখ্যানে আরও দেখা গেছে, পূর্বে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৭টি। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৩ মাসে আরও ১ হাজার ১২০টি নতুন মামলা রুজু হয়। সব মিলিয়ে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ২ হাজার ২১৭টি। সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। এর জন্য সামাজিক অবক্ষয়, অপসংস্কৃতি, সামাজিক অস্থিরতা, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, অশ্লীলতা, মাদকের বিস্তার, ঠিকমতো বিচার না হওয়া এবং বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাই দায়ী বলে মনে করছেন দেশের বিজ্ঞমহল।
শিশু ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই সমাজের নিম্নশ্রেণির। তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। লেখাপড়া না করায় তাদের যথাযথ বোধ তৈরি হয়নি। তারা ধর্ষণের ক্ষতি, সাজা এবং সমাজে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব ঘটনার মূলে পৌঁছতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে তারা এসব ঘটনার বিষয়ে মনোযোগী হয় না। বিভিন্ন অদৃশ্য কারণে থমকে যায় তারা। নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা বেশি যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না তারা। অনেক ক্ষেত্রেই চেনা-জানা লোকজনের মাধ্যমে শিশুরা পাশবিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড়দের মধ্যে ‘দ্বন্দ্বের’ ‘প্রতিশোধ’ নিতে শিশুর সঙ্গে বর্বর নির্যাতন করা হয়। সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শুধু সরকারের একার পক্ষে কাজটি সহজ নয়। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন অধিদফতর বিশেষ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্যানিটেশন প্রকল্প, বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমসহ অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে। নারী ও শিশু ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধর্ষক বা নির্যাতনকারীকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনার অনেক পরে ভিকটিম মামলা করে থাকে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করলে নির্যাতনকারী দ্বিতীয়বার একই অপরাধের সুযোগ পাবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান