‘জাতীয় শোক থেকে ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও জাতীয় মুক্তি’
মুজিব শুধু একজন ব্যক্তির নাম নয়, তিনি আমাদের আদর্শ। তিনি বাংলার মুক্তিকামী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু, সুহৃদ এবং সঠিক পথের দিশারি। পৃথিবীর যে সকল নেতা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন, যাদের গৌরব গাঁথা ইতিহাস রয়েছে, যাদেরকে মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকেন, মুজিব ওই সকল নেতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তার নেতৃত্বে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে আমরা লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছি। মুজিব সাধারণ মানুষ ছিলেন না, তিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, উদার ও বিশাল হৃদয়ের একজন সাহসী বিপ্লবী নেতা ছিলেন। মুজিবের জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। মুজিবের আদর্শ নিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ গবেষণা করবে তা আমাদের প্রত্যাশা। আমরা সঠিকভাবে তাকে উপস্থাপন করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চাই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস/পটভূমি আলোচনা করতে হলে পেছনে ফিরে যেতে হবে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিপ্লবী নেতারা কখনো ক্ষমতার লোভী হন না, আরাম-আয়েশের ধার ধারেন না, তাদের মন-প্রাণ, দেহ, মস্তিষ্কে মানুষের কল্যাণসাধন করাই একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন তিনি হলেন মুজিব। মুজিব সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে আমাদের মনের মাধুরিতে যে উপলব্ধি রয়েছে তা হলোÑ একটি শিশু যখন মায়ের উদরে জন্মগ্রহণ করে তারপর ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, শিশু থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে, আর যৌবন থেকে বৃদ্ধে। ঠিক তেমনই একটি বৃক্ষের কথা চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাব-প্রথমে মাটিতে বীজ রোপণ করতে হয়, তারপর বীজ থেকে চারা গজায়, চারা থেকে বড় গাছ বড় হয়, তারপর ফল ধরে, এরপর ফল খাওয়ার উপযোগী হয়। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস ঠিক একই প্রক্রিয়ায় হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, যা লিখে শেষ করা যাবে না, ঐতিহাসিকভাবে সত্য বন্ধবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফার মাধ্যমে বীজ রোপণ করেছিলেন। অনেক সাধনার পর গাছ গজিয়েছিল, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সনে গণআন্দোলন, ১৯৭০ সনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এ নির্বাচন ছিল সর্বসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন, জনগণের ম্যান্ডেট। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনে মুজিবের দল জয়লাভ করে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র/চক্রান্ত করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগবে নির্বাচনে জয়ী হয়েও মুজিবের দল কেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে না? সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকার লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগের। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিরা কি অপরাধ করেছিল? তাহলে নির্বাচনেরই বা কি প্রয়োজন ছিল? নির্বাচন তো ঘোষণা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। চরম ঝতকি ও সুদৃঢ় মনোবল নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে মুজিব সামরিক আইনের মধ্যেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নির্বাচনের বাংলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছিল, ওই নির্বাচন পর্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় আইনগতভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকারী হয় পূর্ব পাকিস্তানিরা বা মুজিবের দল। আইয়ুব খান নানা বিতর্কিত কাহিনীর জন্ম দিয়ে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে যদি দেশশাসন করতে পারেন তবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতরা কেন দেশ পরিচালনা করতে পারবে না? বাঙালিরা কি অযোগ্য ছিল? ‘অবশ্যই নয়’ বরং বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে সুশৃঙ্খলা, মেধাবী ও সাহসী জাতি ছিল, আজও তা অক্ষুণœ রয়েছে। মুজিবসহ অনেক নেতাই পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী ও সাংসদ ছিলেন। মুজিব দেশ এবং জনগণের স্বার্থে সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রি গভীর রাতসহ ১৯ বার কারাবরণ করেন। ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান ও ভুট্টো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন এবং তারা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ১ মার্চ থেকে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন এবং ৭ মার্চ/১৯৭১ খ্রি. লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, উক্ত ভাষণে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি বলেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের কম্পন সৃষ্টি হয় ও শাসকগোষ্ঠী বেসামাল হয়ে পড়ে। মুজিবের ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতা উত্তাল হয়ে পড়ে এবং জনবিস্ফোরণ ঘটে। এ শক্তির মূল উৎস ছিল ৬ দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম ২ মার্চ শুরু হয়নি, শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে থেকে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্বাধীনতার ইতিহাস আমাদের গৌরবগাঁথা ইতিহাস। ২৫ মার্চের আগে কি ঘটেছিল, স্থিরচিত্রসহ অনেক দুর্লভ ছবি কালের সাক্ষী হয়ে আছে। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদেশেই এদেশের অফিস-আদালত, কলকারখানা, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সার্বিক কর্মকা- পরিচালিত হয়েছিল। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান ও স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পেরেছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণ শুধুমাত্র একটি সাধারণ ভাষণ ছিল না। ৭ মার্চের ভাষণ নতুন প্রজন্মকে মনোযোগ সহকারে উপলব্ধি করতে হবে এবং ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য নতুন প্রজন্মকে অবগত করাতে হবে। ৬ দফার মধ্যে কি ছিল, ১১ দফার মধ্যে কি ছিল, অনেক আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরাও জানে না। কত তারিখে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়েছিল, কতটি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছিল, কারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিভাবে পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র করেছিল, কিভাবে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ঝরেছিল, মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছিল এবং বীরঙ্গনা মা’দের ইতিহাস তা অনেকেই জানেন না। মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলাকে কেন মুজিবনগর নামকরণ করা হয়েছিল। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল বিপ্লবী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কর্তৃক অভিবাদন গ্রহণ, কোন বাহিনীর সদস্যরা তাকে অভিবাদন প্রদান করেছিল, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তার ভাষণ, দিকনির্দেশনা প্রদান, এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ, বর্বর বাহিনীর হাত থেকে কিভাবে জনসাধারণকে রক্ষা করা যায় এবং প্রিয় মাতৃভূমিকে কিভাবে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করা যায় এবং কিভাবে স্বাধীনতা অর্জন করা যায় প্রতিটি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খ- খ-ভাবে ইতিহাসের পাতায় ঘটনাবলি সংরক্ষিত আছে। খ- খ- ইতিহাসকে একত্রিত করে আমিও একটি বই প্রকাশ করতে চাই। স্বাধীনতা ও রক্তঝরা দিনগুলোর ইতিহাস স্মরণ করলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব থিংকস টুডে আদারস থিংক টুমোরো। এ বাক্যটি মুজিবের বেলায়ই প্রযোজ্য, তাই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য গান রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে ১. আমার সোনার বাংলা ২. ও আমার দেশের মাটি ৩. আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ৭. শোন একটি মুজিবুরে থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গানগুলো বলে দেয় হঠাৎ করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়নি। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা। বাঙালিরা হলো গর্বিত জাতি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বাঙালিদেরকে কেউ কোনোদিন দাবিয়ে রাখতে পারবে না। শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও তারা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘৃণ্য চক্রান্তে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে তারা চেয়েছিল। মুজিব পরপারে কিন্তু তার আদর্শ চির অম্লান ও অমলিন হয়ে আছে। লোকান্তরিত মুজিব অনেক বেশি শক্তিশালী, সে কথা সেই ঘৃণ্য চক্র সেদিন বুঝতে পারেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার স্বপ্ন ও আদর্শের ঝা-াকে বয়ে নিয়ে ১৬ কোটি জনগণের এই বাংলাকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশ হবে অফুরন্ত শক্তি ও সম্ভাবনাময় দেশ-এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: উপ-মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি একাডেমি (পিআরএল), সফিপুর, গাজীপুর
সম্পাদনা: আশিক রহমান