যেখানে আপসের সুযোগ নেই : নিষ্পত্তি হতে হবে
এলজিআরডিমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কটাক্ষ করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন।’ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘তার যদি নৈতিকতাবোধ থাকে তাহলে তিনি স্বেচ্ছায় চলে যাবেন। না হলে আইনজীবীরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবেন।’ খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, তার (প্রধান বিচারপতি) যদি সামান্যতম জ্ঞান থাকে, সামান্যতম বুঝ থাকে তাহলে স্বেচ্ছায় চলে যাবেন। তা না হলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে আইনজীবীরা তার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবেন।’ সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আ. লতিফ সিদ্দিকী (টাঙ্গাইল) বলেছেন, ‘রায় কোথা থেকে লেখা হয়েছে তা জানি, কিন্তু বলব না।’ শেখ পরিবারের সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি বলেছেন, ‘এই রায় ইংরেজি পত্রিকার একজন সম্পাদক লিখে দিয়েছে’ প্রভৃতি। মন্ত্রীদের কথা যখন জনগণ প্রত্যাখ্যান করছে তখন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বলছেন যে, এটা দলের বা সরকারের বক্তব্য নয়, বরং এটা ওমুক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত মন্তব্য। শপথ বাক্য পাঠ করে, রাষ্ট্রীয় ফ্লাগ চড়িয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করে কেউ কি ব্যক্তিগত বক্তব্য দিতে পারেন? যদি তাই হয় তবে দল বা সরকার থেকে কোনো সংশোধনী পদক্ষেপ নেওয়া হয় না কেন? যেমনটি নেওয়া হয়েছিল আ. লতিফ সিদ্দিকীর বেলায়, ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করার কারণে। মূলত, দেখা যাচ্ছে যে, বক্তব্য দেওয়ার পর যখন জনগণ কর্তৃক প্রত্যাক্ষিত হয় তখনই দল বা সরকার থেকে বলা হয় যে, ব্যক্তিগত বক্তব্য। ব্যক্তিগত বক্তব্যে যদি বেফাস হয় বা আদালত অবমাননার সামিল হয় তবে সে মুখে তালা লাগানোর বিধান যখন রয়েছে তা কার্যকর করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের রয়েছে, অত্র বিভাগের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার স্বার্থে।
অন্যদিকে সরকারি দল থেকে বলা হয়েছে যে, ‘এ রায় একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক লিখে দিয়েছে।’ বাক্যটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর অর্থ অনেক ব্যাপক। এ বক্তব্যটি সম্পূর্ণভাবে একটি অভিযোগ যেখানে শুধু প্রধান বিচারপতিকে নয় বরং সম্পূর্ণ আপিল বিভাগকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর প্রমাণ করার দায়িত্ব কার? প্রধান বিচারপতি বলেছেন যে, তিনি রাজনৈতিক ফাঁদে পা দিবেন না। যদি তাই হয় তবে বিচার বিভাগকে বা তাকে সরাসরি অভিযুক্ত হলেও কি তিনি তা খ-াবেন না? তিনি আরও বলেছেন যে, ‘জীবন দিবেন কিন্তু পিছু হটবেন না।’ এ বক্তব্যটিও নিশ্চয় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে। তবে কেন এ নীরবতা, নাকি পিছুটান!
রায়টি নিয়ে সরকারের যে টেনশন তা দিনদিন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণ নিশ্চিত যে, সরকার এখন বেকায়দায়, নতুবা প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে এত টেনশন দেখাচ্ছেন কেন? ২১/৮/২০১৭ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এটা সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ নয় অথবা প্রধানমন্ত্রীর অগোচরেও এ সাক্ষাৎকার নয়। প্রধানমন্ত্রীর এক বিশ্বস্ত দূত হিসেবেই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন নিশ্চয় তা সৌজন্যমূলক ছিল না, বরং সেখানে প্রধানমন্ত্রীর একটি জটিল বার্তাই বহন করেছে যার সঙ্গে বৈদেশিক চাওয়া বা না চাওয়ার যোগসূত্র উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের এ টানপড়েন কোথায় শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ পত্রিকান্তরে প্রকাশ দুর্নীতি দমন বিভাগে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১২৬ অভিযোগ জমা জড়েছে। দুদক বলেছে যে, অভিযোগ তারা শর্ট আউট করছে যা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ ভৌগোলিক দিক থেকে একটি ছোট রাষ্ট্র হলে অভিজ্ঞতা ও চমক রয়েছে অনেক। এখানে ২ জন রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। খন্দকার মোশতাক ও জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ ভোগ করার পরও দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অব্যাহত দেওয়া হয়েছিল অধ্যাপক বি. চৌধুরীকে। সাবেক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও জেল খেটেছেন। সাবেক সকল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকলেই পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। অতএব বিচিত্র এই দেশে জেল কখন কার জন্য আশীর্বাদ (!) হয়ে যায় কেউ তা বলতে পারে না। আবার অন্যদিকে উচ্চ আদালতের কোনো রায়ে ভবিষ্যতে যদি ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচন বাতিল হয়ে যায় তবে এখন যারা জেলে পাঠানোর হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন তাদের পরিনণতি উল্টো হয়ে যেতে পারে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার কোন দিকে মোড় নেয় তা এখনো আঁচ করা যাচ্ছে না। পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতি যদিও উত্তরাধিকার ভিত্তিক, তবুও এর স্থায়িত্ব দীর্ঘস্থায়ী নয়।
‘একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক এই রায় লিখে দিয়েছে’ এ বক্তব্যটি আপিল বিভাগ কিভাবে নিয়েছেন তা জানি না, তবে আমি মনে করি এটা অভিযোগ, সমালোচনা নয়। অভিযোগ প্রমাণ করার দায়িত্ব অভিযোগকারীর। অভিযোগ প্রমাণ ব্যর্থতায় বিচার বিভাগের সম্মান ও ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখতে আদালত অবমাননার দায়ে বক্তব্যটির ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য অভিযোগকারীকে আদালতে তলব করার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির অবশ্যই রয়েছে, নতুবা অভিযোগকারীরাই ভবিষ্যতে বলে বেড়াবে যে, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল মশা বলে কত জল?’
বিচার বিভাগকে অনেক ধকল সইতে হচ্ছে। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এক্ষেত্রে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রেও আছে। অন্য জায়গা (পত্রিকার সম্পাদক) থেকে রায় লেখানোর প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তা হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক তদন্ত হতে হবে, নতুবা আদালত অবমাননার কৈফিয়ৎ তলব করে এর নিষ্পত্তি করতে হবে, নতুবা বক্তব্যটি বিলীন হওয়ার পরিবর্তে ইথারে ভাসতেই থাকবে যা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির জন্য একটি কালোছায়া হয়ে রয়ে যাবে। কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে এখানে আপসের কোনো সুযোগ নেই। অভিযোগটির অবশ্যই আইনগত নিষ্পত্তি হতে হবে, নতুবা এটা একটি কালো নজির হয়ে থাকবে চিরকাল, যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। (সমাপ্ত)
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
সম্পাদনা: আশিক রহমান