রোহিঙ্গা সমস্যা : মুসলিম বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সংযুক্ত করে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দীর্ঘ একটি সময়ের ব্যাপার। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে তো সারা পৃথিবীকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে বাংলাদেশ যাবে বা কীভাবে যাবে নাÑ সেটা আলাদা একটি বিষয়। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এগিয়ে আসতে পারে। এখানে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারত এবং চীনকে সঙ্গে নিয়ে যদি বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথে, সংকট মোকাবিলা করতে পারত, তাহলে একধরনের সমাধান প্রক্রিয়া হয়তো বের হতো। চীন এবং ভারতকে যদি সঙ্গে নিতে পারত, তাহলে হয়তো পরবর্তী ধাপে আন্তর্জাতিক ফোরামেÑ জাতিসংঘ বা অন্যান্য ফোরামে যাওয়া যেত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়ায় কাজ করে বা যে প্রক্রিয়াতে কাজ করছে, সেখানে চীন এবং ভারতকে সঙ্গে নিয়ে যদি কাজ করা যেত তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে যেত, বিষয়টি তাও নয়। কারণ, চীনের সরাসরি স্বার্থ আছে মিয়ানমারে। মিয়ানমারের যে খনিজ সম্পদ, সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। সেই গ্যাস চীন নিয়ে যাচ্ছে তাদের দেশে এবং চীনের অনেক প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করছে। তাই চীনের সরাসরি মিয়ানমারের সঙ্গে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় আছে। চীন এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে মিয়ানমারের উপর চাপ দিবে। মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সমাধান করার জন্য বাধ্য করবে সে রকম জায়গাতে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তারপরও যেহেতু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো, সে কারণে বাংলাদেশ যদি কূটনৈতিক উদ্যোগে চীনের সঙ্গে একটা বড় চেষ্টা করত, তাহলে হয়তো চীন মিয়ানমারের উপরে পুরোপুরি চাপ না দিলেও কিছুটা হয়তো চাপ দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এটা চীনের জায়গা থেকে বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতের ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম, ভারতের রিলায়েন্সসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারে এসে গ্যাস অনুসন্ধান করছে এবং গ্যাস পেয়েছেও। এই গ্যাস মিয়ানমার থেকে ভারতে নিয়ে যেতে চায়। সে কারণেই মিয়ানমারের সঙ্গে তাদেরও একটা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় যুক্ত হয়েছে। ভারত মিয়ানমারের স্বার্থ না দেখে বা ভারত মিয়ানমারের নীতিকে সমর্থন না করে, বাংলাদেশের নীতিকে সমর্থন করবে এ রকম সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরও যেহেতু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক ভালো এবং বাংলাদেশ ভারতের অনেক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং রেখেছে, সেক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গেও যদি আলাদাভাবে আলোচনা করত, সেক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকেও কিছুটা সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সেটা পর্দার অন্তরালে কতটা করেছে তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু পর্দার বাইরে আমরা দৃশ্যমান তেমন কিছু উদ্যোগ দেখি না। আবার এই অঞ্চলে ভারত এবং চীনকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে গিয়ে বাংলাদেশের খুব বেশি কিছু লাভ হবে বলে মনে হয় না। সুতরাং সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে গিয়ে সমস্যা সমাধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আমাদের নীতিনির্ধারকেরা যা বলেন, এগুলো আসলে গল্পের মতো শোনায়। এগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। এমন অবস্থায় আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান খুব দ্রুত দেখছি না। এবং সেই সমাধানের জায়গাটাতে বাংলাদেশের কোনো অগ্রগতি আছে বলেও মনে হচ্ছে না। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি এবং প্রায় দীর্ঘস্থায়ী ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ এবং ভবিষ্যতে যত সময় যাবে, ততই বাংলাদেশের সমস্যাটা বাড়ারই সম্ভাবনা আছে, কমার সম্ভাবনা আমি দেখছি না।
মুসলিম বিশ্ব বলতে গেলে মুসলিম স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরব থাকে, এ রকম সাধারণত দেখা যায় না। এক্ষেত্রেও নেই। ইন্দোনেশিয়া সরব আছে ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান থেকে এবং মালয়েশিয়া সরব আছে তাদের অবস্থান থেকে। এর বাইরে ওআইসি যদি চাপ দিত, ওআইসি যদি একটু সরব থাকত তাহলে একটু কাজ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আন্তর্জাতিক অবস্থানের কারণে ওআইসিও চুপচাপ। এই জায়গা থেকে ওআইসির সঙ্গে বাংলাদেশ কতটা আলোচনা করেছে বা কতটুকু আলোচনা করেনি এ বিষয়টিও দৃশ্যমান নেই। এমনকি এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। বাংলাদেশ যদি ওআইসিকে কাছে লাগিয়ে ওআইসির সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে চাপের ব্যবস্থা করত, তাহলে সংকট সমাধানের সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারত। সে জায়গাতে বাংলাদেশ খুব বেশি করেছে বলে মনে হয় না। অন্তত পক্ষে আমি জানি না বাংলাদেশ এ রকম কিছু করেছে বলে।
পরিচিতি: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
মতামত গ্রহণ: বায়েজিদ হোসাইন
সম্পাদনা: আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ