উপায়-উপকরণ অবলম্বন তাওয়াক্কুল পরিপন্থি নয়
মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ : তাওহীদের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ও সুফল ‘তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ’ বা একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা রাখা। ‘তাওয়াক্কুল’ আরবি শব্দ। এর অর্থ, ভরসা করা। অর্থাৎ, দুনিয়া-আখেরাতের সকল কাজে, সকল মাকসাদ হাসিল করার জন্য এবং সকল বিপদ-মুসীবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একমাত্র আল্লাহ পাকের উপর ভরসা রাখা। এটা ইসলামের শিক্ষা। ঈমানের শিক্ষা।
কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় তাওয়াক্কুলের কথা এসেছে। হাদীস শরীফেও এ বিষয়ে অনেক বর্ণনা আছে। তাওয়াক্কুল কী, এর উপকারিতা কী, দুনিয়ার উপায়-উপকরণ অবলম্বনের সাথে তা সাংঘর্ষিক কি না এ ধরনের অনেক বিষয়ের সমাধান কুরআন-সুন্নাহতে আছে।
কার উপর তাওয়াক্কুল করতে হবে? মানুষকে দুনিয়ার জীবনে ভরসা করতে হয়। কোথাও না কোথাও তাকে আত্মসমর্পন করতেই হয়। সব দুঃখ বেদনা কোথাও না কোথাও বলতেই হয়। সেই স্থানটা কোনটা? যারা ঈমান থেকে বঞ্চিত, ঈমানের শিক্ষা থেকে মাহরূম, তারা সেই স্থান এমন ব্যক্তি বা বস্তুকে বানিয়ে নেয় বাস্তবে যাদের কল্যাণ-অকল্যাণের কোনোই ক্ষমতা নেই। পক্ষান্তরে আল্লাহ যাদেরকে ঈমান দান করেছেন, তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেছেন তারা তাদের সকল বেদনা, সকল প্রার্থনা এমন একজনের কাছে পেশ করে যিনি বাস্তবেই মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক। আর যিনি সৃষ্টির প্রতি পরম দয়ালু। আল্লাহ বলেন, ‘ভরসা কর পরাক্রমশালী করুণাময়ের উপর।’ (সূরা শুআরা : ২১৭) আরো ইরশাদ করেন, ভরসা কর চিরঞ্জীবের উপর, যার মৃত্যু নেই। (সূরা ফুরকান : ৫৮)
তাওয়াক্কুলের হাকীকত বা তাওয়াক্কুল হচ্ছে ভরসা করা, জীবনের সকল বিষয়ে, কল্যাণ লাভের ক্ষেত্রেও, অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাবার ক্ষেত্রেও। আর তা এমন সত্ত্বার উপরই হতে পারে যিনি সকল বস্তুর ¯্রষ্টা। বস্তুর গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ¯্রষ্টা। যিনি গোটা জাহানের পালনকর্তা এবং যিনি দুনিয়া-আখিরাতের সকল কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক, এমন সত্ত্বার উপরই ভরসা করা যায়। তাঁর পরিবর্তে মানুষ যদি অন্য কারো উপর ভরসা করে তাহলে তা হবে তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী।
তাওয়াক্কুলহীনতার বিভিন্ন পর্যায় : ভালোর যেমন স্তরভেদ আছে তেমনি মন্দেরও আছে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা করারও বিভিন্ন স্তর ও পর্যায় আছে। ভরসা করা অন্তরের কাজ। এটা আল্লাহর প্রতিই থাকতে হবে। একারণে অন্য কারো উপর ভরসা করলে তা নিঃসন্দেহে তাওয়াক্কুল পরিপন্থী ও অন্যায়। এখন যদি এর সাথে শিরকি কোনো আকীদা যুক্ত হয় যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সৃষ্টিকে অলৌকিক ক্ষমতার মালিক মনে করে তার উপর ভরসা করে তাহলে তা সরাসরি শিরক। আর যদি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বিশ্বাস করে নয় বরং পার্থিব অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতার কারণে ভরসা করে তবে তা সরাসরি শিরকে আকবর না হলেও তা গুনাহ ও তাওয়াক্কুল বিরোধী। এটা প্রকৃতপক্ষে পার্থিব উপায়-উপকরণের উপর ভরসা, যা নিষেধ। ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপরই করতে হবে।
কর্মহীনতা তাওয়াক্কুল নয় : ভরসা ও ব্যবহারের পার্থক্য আছে। উপায়-উপকরণের উপর ভরসা করা যাবে না এর অর্থ এই নয় যে, তা ব্যবহারও করা যাবে না। বৈধ উপকরণ বৈধ পন্থায় ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু ভরসা রাখতে হবে আল্লাহর উপর। তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর ভরসা করার অর্থ দুনিয়ায় কাজকর্ম পরিত্যাগ করা নয়। ভরসা করা অন্তরের বিষয়। মুমিন অন্তর থেকে বিশ্বাস করে আমার সকল ভালো-মন্দ আল্লাহ পাকের হাতে, তবে দুনিয়ার জীবনের এবং আখিরাতের জীবনের সফলতা অর্জনের জন্য আল্লাহ পাক কিছু পথ ও পন্থা নির্ধারিত করেছেন। তা আমাকে অবলম্বন করতে হবে। ভালো-মন্দ আল্লাহর হাতে, কিন্তু আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে সেই ভালো পাওয়ার জন্য এবং সেই মন্দ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ যে পথে চলার আদেশ করেছেন সে পথেই আমাকে চলতে হবে। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় ক্ষেত্রেই একথা সত্য। কর্মহীন বসে থাকার কথা আল্লাহ পাক দুনিয়ার ব্যাপারেও বলেননি, আখিরাতের ব্যাপারেও বলেননি। প্রথমে আখিরাতের বিষয়টি দেখা যাক। ইসলামে তো বলা হয়নি যে, আখিরাতে যেহেতু আল্লাহই নাজাত দিবেন তাই কোনো আমল করতে হবে না- নামায পড়তে হবে না, রোযা রাখতে হবে না, পর্দা করতে হবে না, হালাল মোতাবেক চলতে হবে না, হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে না। এ কথা তো ইসলাম বলেনি; বরং গুরুত্বের সাথে এসব হুকুম-আহকামের পাবন্দী করতে বলেছে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে আল্লাহ পাকের উপর অধিক ভরসাকারী আর কে হতে পারেন? তিনিই তো সবচেয়ে বড় ভরসাকারী। তাঁর পর সাহাবায়ে কেরাম সবচেয়ে বড় ভরসাকারী। কিন্তু তাঁরা আখেরাতের মুক্তি ও সফলতা অর্জনের জন্য পুরা জীবন আল্লাহ পাকের বিধান মোতাবেক চলেছেন। কিন্তু এর অর্থ কর্ম পরিত্যাগ করা নয়। সূরা জুমুআর প্রসিদ্ধ আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে যে, নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিযিক) সন্ধান করবে। … (সূরা জুমুআ ৬২ : ১০) আল্লাহ তাআলাই আদেশ করেছেন তাওয়াক্কুল করার, আল্লাহর উপর ভরসা রাখার, আবার তিনিই আদেশ করেছেন, নামায শেষে ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ার, আল্লাহর অনুগ্রহ বা রিযিক অন্বেষণ করার। এর তাৎপর্য হল মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী কাজ করবে, কিন্তু ঈমান থাকবে আল্লাহর ফয়সালার উপর। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কর্ম ও উপকরণের মাঝে, কিন্তু অন্তর আল্লাহর সাথে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে কর্ম করছি আর অন্তরে ভরসা আল্লাহর উপর পোষণ করছি।