যার প্রতিবেশি ক্ষুধার্ত থাকে সে মুমিন নয়
সাইদুর রহমান : প্রতিবেশি মানবসমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বছরের পর বছর পার হয় পাশের বাড়ির কারো সাথে কোনো কথা হয় না, খোঁজ খবর নেওয়া হয় না ; বরং বিভিন্নভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হয়। অথচ প্রতিবেশির সাথে সদাচরণ ও তাকে কষ্ট না দেওয়াকে ঈমানের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেশি বলতে এখানে সবাই শামিল। প্রতিবেশি ঘর, রাষ্ট্র আত্মীয়-স্বজন সহকর্মী, মুসলমান হিন্দুসহ সকল ধর্মের মানুষই প্রতিবেশি হতে পারে। সবাই প্রতিবেশীর অন্তর্ভুক্ত।
প্রতিবেশির অধিকারের গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে রাসূল স : তরকারির ঝোল পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রতিবেশিকে শরীক করার কথা বলেছেন। হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যর রা.- কে বলেন, হে আবু যর, তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে দিও এবং তোমার প্রতিবেশিকে তাতে শরিক করো। (মুসলিম,হাদীস ২৬২৫) অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জিবরীল (আ.) আমাকে প্রতিবেশির হকের ব্যাপারে এত বেশি তাকিদ করেছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশিকে মিরাছের অংশিদার বানিয়ে দেয়া হবে। (দবুখারী ৬০১৪; মুসলিম ২৫২৪) তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশির সাথে সদাচরণ করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৮৫)
কুরআনে প্রতিবেশির হক সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছন, ( অর্থ) তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং কোনো কিছুকে তার সাথে শরিক করো না। এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতীম, অভাবগ্রস্থ, নিকট-প্রতিবেশি, দূর-প্রতিবেশি, সংগী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের দাস-দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।
হযরত ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশি না খেয়ে থাকে। (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ২৬৯৯; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১১২) আমি প্রতিবেশির প্রয়োজন পুরা করব তাহলে আল্লাহ আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দিবেন এবং আমার সহায় হবেন। হাদীস শরীফে এসেছে, যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পুরা করে আল্লাহ তার প্রয়োজন পুরা করেন। (সহীহ বুখারী,হাদীস ২৪৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮০) প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করতে হবে। কারণ প্রতিবেশি জীবনের আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। ইমানের দাবি হলো প্রতিবেশির সাথে সদাচার করা। দূর্ব্যবহার না করা। এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে, হযরত আবু শুরাইহ্ রা. বলেন, আমার দুই কান শ্রবণ করেছে এবং আমার দুই চক্ষু প্রত্যক্ষ করেছে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং আখেরাতে বিশ্বাস রাখে সে যেন স্বীয় প্রতিবেশিকে সম্মান করে। সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় আছে ‘সে যেন স্বীয় প্রতিবেশির সাথে সদাচরণ করে।’ (বুখারী, হাদীস ৬০১৮; মুসলিম, হাদীস ৪৮)
আবার মন্দ প্রতিবেশি থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে হবে। কারণ প্রতিবেশি খারাপ হলে ঘরবাড়িতে অশান্তি লেগে থাকে। অপরের ছিদ্রাণে¦ষণ করার কারণে ঝগড়া-বিবাদ চলতেই থাকে। প্রতিবেশীর শিষ্টাচার মন্দ হলেও চরিত্র খারাপ হলে সকলকেই মন্দের দিকে নিয়ে যাবে। প্রতিবেশীর হক নষ্ট করা বা তাকে কষ্ট দেওয়া অনেক বড় অন্যায়। কখনো দুনিয়াতেই এর সাজা পেতে হয় আর আখেরাতের পাকড়াও তো আছেই। আমার অর্থবল বা জনবল আছে বলে আমি প্রতিবেশীর হক নষ্ট করে পার পেয়ে যাব এমনটি নয়। হাঁ, দুনিয়ার আদালত থেকে হয়ত পার পেয়ে যাব, কিন্তু আখেরাতের আদালত থেকে আমাকে কে বাঁচাবে? হযরত উকবা ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রথম বাদী-বিবাদী হবে দুই প্রতিবেশি। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৩৭২; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৮৩৬)
প্রতিবেশিকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়টিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানের দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করেছেন। কোনো ব্যক্তি মুমিন আবার প্রতিবেশিকে কষ্টও দেয় তা ভাবা যায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!!! সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, সে কে হে আল্লাহর রাসূল? রাস্লূুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশি নিরাপদ নয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৬)
আরেক হাদীসে এসেছে, যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে ও আখেরাতে বিশ্বাস করে সে যেন স্বীয় প্রতিবেশিকে কষ্ট না দেয়। (দ্র. সহীহ বুখারী হা. ৬০১৮) কষ্ট দেওয়ার বিভিন্ন রূপ হতে পারে। যেমন, জানালা দিয়ে উঁকি দেয়া, চলা ফেরার ক্ষেত্রে দৃষ্টি অবনত না রাখা, প্রতিবেশীর বাসার সামনে ময়লা ফেলা, জোরে ক্যাসেট বাজানো, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় প্রতিবেশীর ঘুম বা বিশ্রামের ক্ষতি করা, প্রতিবেশীর চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া, গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি। নিজের গৃহপালিত পশু ছেড়ে দিলাম আর তা প্রতিবেশীর ফসলের ক্ষতি করল কিংবা প্রতিবেশীর অবলা পশু এসে কিছু নষ্ট করেছে বলে আমি পশুটির কোনো ক্ষতি করলাম বা পশুর মালিককে গালি দিলাম। এসকল ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া ও ধৈর্য্য ধারণ করা উচিত। আল্লাহ এর প্রতিদান দিবেন। প্রতিবেশির দোষ ঢেকে রাখা ; পাশাপাশি থাকার কারণে একে আপরের ভালো মন্দ কিছু জানাজানি হয়। গোপন করতে চাইলেও অনেক কিছু গোপন করা যায় না। প্রতিবেশীর এসকল বিষয় পরস্পরের জন্য আমানত। নিজের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণেই একে অপরের দোষ ঢেকে রাখা জরুরি। আমি যদি তার দোষ প্রকাশ করে দিই তাহলে সেও আমার দোষ প্রকাশ করে দিবে। আর আমি যদি তার দোষ ঢেকে রাখি তাহলে সেও আমার দোষ গোপন রাখবে। এমনকি এর বদৌলতে আল্লাহও আমার এমন দোষ গোপন রাখবেন, যা প্রতিবেশীও জানে না। হাদীস শরীফে এসেছে, যে তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ ঢেকে রাখে আল্লাহও কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮০)