নবী সা. ও কুরআন প্রেরণের উদ্দেশ্য কী?
মুফতি তকী উছমানী : কুরআনের এক আয়াতে আল্লাহ পাক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৃথিবীতে প্রেরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ মুমিনদের ওপর বড়ই দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের থেকেই একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন।’ যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল।-আলে ইমরান : ১৬৪
আল্লাহর প্রথম অনুগ্রহ হলÑ রাসূল প্রেরণ। দ্বিতীয় অনুগ্রহ, মানুষের মধ্য থেকে প্রেরণ। অর্থাৎ এমন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি মানবিক চাহিদাগুলো বোঝেন। তিনি বোঝেন কোন্ জিনিস মানুষের প্রয়োজন, মানুষের কী দরকার। কোনো ফেরেশতা পাঠাননি, যিনি পানাহার করেন না। এরপর আল্লাহ পাক নবী প্রেরণের চারটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন- ১. ‘তাদেরকে কিতাব ও আয়াতসমূহ পড়ে শোনান।’ ২. ‘তাদেরকে পবিত্র করেন।’ অর্থাৎ তাদের চরিত্রকে পূতপবিত্র ও সুন্দর করেন, উত্তম ও শ্রেষ্ঠ বানান। ৩-৪ ‘তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের তালীম দেন।’
কুরআন তিলাওয়াত একটি পৃথক উদ্দেশ্য। এ চারটি উদ্দেশ্য আল্লাহ পাক চার স্থানে উল্লেখ করেছেন। এতে এগুলোর গুরুত্ব বুঝা যায়। এ চারটির মধ্যে দুইটির আলোচনা করছি। কিতাবের তিলাওয়াত এবং কিতাবের তালীম। আল্লাহ পাক কুরআন শরীফের আয়াতের তেলাওয়াতকে নবী প্রেরণের পৃথক একটি উদ্দেশ্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর কুরআন বোঝাও আলাদা আরেকটি উদ্দেশ্য। এ দ্বারা অনেকের ভুল বুঝাবুঝির অবসান হবে বলে আশা করি, যারা বলেন, মক্তবে বাচ্চাদেরকে তোতা পাখির মতো কুরআন মুখস্থ করানো হয়। তারা অর্থ ও ব্যাখ্যা না বুঝলে তাদের কী ফায়দা হবে? কুরআনের এ আয়াত ওইসব লোকদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান করে ঘোষণা দিচ্ছে যে, কুরআনের তেলাওয়াত স্বয়ংসম্পূর্ণ পৃথক একটি উদ্দেশ্য। ইলমে তাজবীদের সৌন্দর্য কুরআন মজীদ হচ্ছে হেদায়াতের ব্যবস্থাপত্র, যা সাধারণ ডাক্তার বা হেকিমদের ব্যবস্থাপত্রের মতো নয়। কারণ তাদের ব্যবস্থাপত্র বুঝতে না পারলে কোনো উপকারে আসে না। আর কুরআন শরীফ হচ্ছে হেদায়াতের এমন ব্যবস্থাপত্র যার এক-একটি অক্ষর পাঠ করলে দশ দশটি নেকী পাওয়া যায়।
তেলাওয়াত হচ্ছে কুরআন বুঝার প্রথম ধাপ কুরআন কারীম এমন একটি কিতাব, যা নিয়ে আসতেন হযরত জিবরীল আ.। তিনি কুরআন পড়ে শোনাতেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন ফেরেশতা কুরআন পড়তে আরম্ভ করবেন তখন আপনি তাঁর অনুসরণ করুন।’ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে কুরআন শরীফ এভাবেই পড়ে শোনাতেন যেভাবে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর সাহাবায়ে কেরাম তা শিখতেন। আলহামদুলিল্লাহ, আজ আমরা উচ্চকণ্ঠে বলতে পারি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতেন আমরা হুবহু সেভাবেই তেলাওয়াত করছি। এতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আল্লাহ পাক এ উম্মতকে এই মর্যাদা দিয়েছেন যে, ইলমে তাজবীদের ন্যায় একটি শাস্ত্র দিয়েছেন। কুরআনের অর্থ বুঝার জন্য কুরআনের আয়াতসমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ করা ও পড়া প্রথম শর্ত। কেউ সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে না পারলে সে কী করে কুরআন বুঝবে? তাছাড়া কুরআনের তেলাওয়াত হচ্ছে পৃথক একটি উদ্দেশ্য। তাই কেউ একথা মনে করবেন না, মক্তবে কুরআন পাঠ শেখা ও শেখানো বেকার। নাউযুবিল্লাহ। আরবীভাষীদের কিতাবুল্লাহর শিক্ষাদান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্যাবলির মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে কিতাবুল্লাহ শিক্ষাদান। এ উদ্দেশ্যের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদেরকে কিতাবের তালীম বা শিক্ষা দেন।’ কিতাবের তালীম দ্বারা কী উদ্দেশ্য? শুধু আয়াতের অনুবাদ বলে দিবেন?
তিনি তো শিক্ষা দিবেন আবু বকর, উমর, উসমান, আলী রা.কে। তারা কি আরবী ভাষা জানেন না? এঁদের প্রত্যেকেই তো আরবী ভাষায় দক্ষ ছিলেন। হযরত উমর ফারুক রাযিআল্লাহু আনহু আরবী ভাষায় এত দক্ষ ছিলেন যে, বড় বড় সাহিত্যিক পর্যন্ত তাঁর সামনে নিজেদের ‘কালাম’ পেশ করলে তা সংশোধন করতেন। আরবের মহিলারাও তো ছিলেন স্বভাবকবি। অপরদিকে কুরআনের ঘোষণা ‘কুরআন স্পষ্ট আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ তাহলে তো আরবী ভাষা শিক্ষা করার জন্য বা কুরআনের অর্থ বুঝার জন্য তাঁদের কোনো শিক্ষকের কিতাব শিক্ষা দেওয়া নবীর দায়িত্ব। মক্কার মুশরিকদের দাবি ছিল ‘কুরআন কেন একবারে নাযিল হয় না।’ -ফুরকান : ৩২ আল্লাহ চাইলে তো এমন হত যে, লোকেরা রাতে ঘুমাতে যেত আর সকালে উঠে দেখত যে, বালিশের নিচে উন্নত বাঁধাই করা কুরআনের কপি। আর তাদেরকে বলে দেওয়া হত, নাও, কিতাব এসে গেছে। পড়, বুঝ এবং আমল কর। এমন হলে তা তো অলৌকিক বিষয় হত। ফলে ঈমান আনারও আশা বেশি করা যেত। কিন্তু এমন হয়নি; বরং কুরআন এল, সাথে নূর নিয়ে এল। যেন এমন না হয় যে, তোমরা নিজেদের মনমতো অর্থ বুঝতে আরম্ভ কর এবং নিজের বুঝমতো আমল শুরু কর। এ কারণেই আল্লাহ পাক শিক্ষক পাঠিয়েছেন এবং তাকে কিতাব শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আমি তোমার উপর কুরআন এজন্য অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি লোকদের সামনে এসব বিষয় স্পষ্ট করে দাও, যা তাদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।’ নাহল : ৪৪
‘কুরআন সহজ’-এর অর্থ কী? কুরআন শরীফের একটি আয়াতের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে কারো কারো ভুল হয়। এখানে তা দূর করা জরুরি। কুরআন বলে, ‘আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি।’ অতএব কেউ আছে কি যে উপদেশ গ্রহণ করবে? কেউ কেউ বলে, আমরা কুরআন থেকেই কুরআনের অনুবাদ নিজে বুঝব এবং এর উপর আমল করব। যারা এমন কথা বলে, তারা এ আয়াতের মর্মই বুঝেনি। খুব ভাল করে মনে রাখতে হবে যে, কুরআনের বিষয়বস্তুসমূহ দুই প্রকার : প্রথম প্রকার : কিছু আয়াত এমন রয়েছে যেগুলোতে আল্লাহপাক মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন যে, আল্লাহ এক, আখিরাত সম্পর্কে বলেছেন যে, একদিন তোমাদের সকলকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এ উপদেশ একজন সাধারণ মানুষ শুধু অনুবাদ পড়ে গ্রহণ করতে পারবে।
এ কারণেই তো কুরআন স্পষ্ট বলেছে, উপদেশ গ্রহণের ক্ষেত্রে সহজ। দ্বিতীয় প্রকার : দ্বিতীয় প্রকারের বিষয়বস্ত্ত, যেগুলোতে আল্লাহ পাক আহকাম ও আমছাল বা উপমা পেশ করেছেন। এসব হুকুমের ব্যাপারে আল্লাহ নিজে বলেন- ‘আমি এসব উপমা মানুষের উপকারার্থে প্রদান করে থাকি তবে তা কেবল ইলমওয়ালারাই বুঝবে।’ আর ইলম তা-ই যা সাহাবায়ে কেরাম নবী স : এর কাছে শিখেছেন। কুরআন বুঝতে আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন এ কারণেই কুরআনের কোনো কোনো স্থানে প্রথমে তাদের পরিশুদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে তারপর কিতাব পড়ার কথা বলা হয়েছে। এরপর অর্থ শিক্ষা দিলে ফায়দা হবে। প্রথমে আল্লাহর কাছে দুআ করুন, তিনি যেন পাক-পবিত্র করে দেন এবং ইখলাস ও হকের তলব পয়দা করে দেন। এরপর শিক্ষক ও মুরবিবর নিকট থেকে তা শিক্ষা করুন। তাহলে কুরআনের নূর হাসিল করা সম্ভব হবে। নতুবা গোমরাহীর দ্বার উন্মুক্ত হবে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। অনুলিপি : সাইদুর রহমান