জেগে ওঠো, ধেয়ে আসছে ওরা
ফাহমিদা হক
আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, এই মুহূর্তে আমাদের হাজারো সমস্যার মধ্যে ধর্ষণ নামক মারাত্মক ব্যাধি আমাদের সমাজে ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। আর এর ছোবল থেকে রক্ষা মিলছে না দুধের শিশুটি থেকে শুরু করে অবুঝ প্রতিবন্ধি মেয়েটিও। ধর্ষণ নামক এই ব্যাধির নৃশংসতা, বর্বরতা যেই হারে বিস্তার লাভ করছে, তা থেকে সমাজের কেউই রক্ষা পাবে না। এখনই, তাকে রুখে দিতে না পারলে যে কোন দিন, যে কোন মুহূর্তে আমাদের যে কারো ঘরে হানা দিবে এবং তা থেকে বেঁচে যাবেন, এই নিশ্চয়তা দেয়ার মতো সাহস কারো নেই। মনে রাখতে হবে, আক্রান্ত জীবের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য যেমন আশু সুচিকিৎসা প্রয়োজন, তেমনি আক্রান্ত মানব সমাজের সার্বিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য আশু যথোপযুক্ত প্রদক্ষেপ জরুরি।
নারীর উপর ধর্ষণের দৈহিক, মানসিক, এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া ভাবলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এটি কত বড় জঘন্য কাজ। ধর্ষণের ফলে একটা মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরে। নিজে অন্যায় বা ভুল না করেও সামাজিকভাবে নানান বঞ্চনার মুখোমুখি হয়ে দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়, এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা পরিবারের সদস্যসহ সবার অপমান সহ্য করে যেতে হয়। একটা নারীর প্রতি যত ধরনের সহিংসতা দেখা যায়, তার মধ্যে ধর্ষণ হচ্ছে সবচেয়ে বেশী মারাত্মক এবং প্রচলিত ও অসামাজিক।
আমাদের সমাজের যে আইনি কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তা একটা ধর্ষিতা নারীর জন্য সমস্যার সমাধান তো নয়ই, বরং সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ও শিথিল মূল্যবোধের কারণে নারী নির্যাতনের মামলাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে থানায় গ্রহণ করা হয় না। নির্যাতনকারী যদি প্রভাবশালী হয় তাহলে মামলা না নেয়া, ভিকটিমকে অযথা হয়রানি করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। যদিওবা মামলা নেয়া হয়, তার তদন্ত ভাল ভাবে হয় না। কখনো আবার তদন্ত রির্পোট ঠিক মত জমা দেয়া হয় না। এরকম হাজারটা হয়রানীতে জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠে। আর এভাবে অপরাধকে আরো উসকে দেয়া হয়। যার ফলে অপরাধী আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। ধর্ষণ কোন নতুন ঘটনা নয়, তবে আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো যে, ইদানিং ধর্ষণের মাত্রা এবং নৃশংসতা বেড়েছে যা খুবই চিন্তার বিষয়। ২০১৩ সালে মানিকগঞ্জে বাসে ধর্ষণের শিকার হয় পোশাক শ্রমিক। চলন্ত বাসে এধরনের প্রথম অপরাধের খবরে দেশে তোলপাড় হয়েছিল। কিন্তু মন্দের ভালো যে তাকে হত্যা করা হয়নি। ২০১৫ সালে রাজধানীতে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় এক গারো নারীকে। ২০১৫ সালে গাজীপুরের কালিগঞ্জে নৌকায় ৪ মাঝির হাতে ধর্ষণের শিকার হয় এক নারী কর্মী। ২০১৬ সালে ময়মনসিংহে বাসে ধর্ষণ হয়। ২০১৬ সালে বরিশালে নাযুল্লাবাদে বাসে চালক ও সহকারীর হাতে ধর্ষণের শিকার হন দুই বোন। ২০১৭ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে ট্রাকে ধর্ষণের শিকার হয় এক কিশোরী। আর এসব ধর্ষণের ঘটনাগুলোর দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতেই দুর্বৃত্তদের দুঃসাহস বেড়ে চলছে। এটাও স্পষ্ট যে আরো এমন ঘটনা সামাজিক চাপের কারণে প্রকাশ্যেই আসতে পারেনি। একটু লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পারি, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্ষক হচ্ছে চালক ও তার সহকারী। গণপরিবহন যেখানে ‘নিরাপদ’ বিবেচিত হয়, সেখানে এই প্রবণতা সমাজ ও শৃঙ্খলার জন্য বিপজ্জনক, তাতে সন্দেহ নেই।
সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্যও এটা সতর্ক সংকেত। ভুলে গেলে চলবে না নারীর নিরাপত্তাহীনতার নির্মম নগ্ন বহিঃপ্রকাশের ইঙ্গিত এসব পরিবহনে ধর্ষণ। তাই জড়িতদের অবিলম্বে কঠোর শাস্তি না হলে এধরনের অঘটন বাড়তেই থাকবে। যেসব নারীরা এধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন, কেবল সেসবের শাস্তি নয়, আর যাতে কেউ এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির দুঃসাহস না পায়, সেজন্যও এই ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োজন। গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে এখন আর প্রতিকার কোন স্থায়ী সমাধান নয়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা করাই বেশী জরুরী, যা করতে হবে সরকার, সমাজ, পরিবার ও নারীর নিজের উদ্যোগে, সবার মিলিত প্রচেষ্টায়।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন
সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ