একটি গানের অনুষ্ঠান ও আমাদের মনন বিকৃতি
অজয় দাশগুপ্ত
আমাদের ধারণা প্রচলিত কলাম মানে রাজনীতি নিয়ে লেখা। সমাজ কলামলেখক বা চলমান বিষয় নিয়ে লেখার মানুষগুলোকে মনে করে সমালোচক। কারো মতে একচোখা। সত্যি বলতে কি রাজনীতিও আসলে বিষয় না। বিষয় মূলত দল। দল আর নেতা নামধারীদের নিয়ে লেখা আর কথার দেশে মানুষ এদের ওপর বিরক্ত। জীবনে মা বাবা আত্মীয় স্বজন কিংবা বন্ধুদের কাছে যত তিরস্কার শুনেছি, তার একশগুণ বেশী শুনেছি কলাম লিখে। নিজেতো নিজে নিজের চৌদ্দপুরুষ, ধর্ম, দেশকেও ছেড়ে কথা বলেনি অনেকে। আসলে এমন এক দেশ ও সমাজ আমাদের, আমরা রাজনীতির বাইরে পা রাখতে ভুলে গেছি। দেশের ভূত ভবিষ্যত এমন কি অতীতকে কেন্দ্র করে ঘুরছে রাজনীতি। এমন রাজনৈতিক কলহের দেশ দুনিয়ায় আর একটিও নাই। এখন এটা মহামারী। আনন্দ বিনোদন মিডিয়া নাটক সিনেমা সব জায়গাতেই এর প্রকোপ।
আমাদের মত দেশে জনবহুল সমাজে নামকরা বা দৃষ্টি আকর্ষণ করা সহজ কিছু না। যে যখন যেকোন কারণে নাম করেন কিংবা জনপ্রিয় হন, আমি অন্তত তার দিকে ফিরে তাকাই। কোন না কোন বিশেষ গুণ ব্যতীত এটা হবার কথা না। এমনকি এরশাদ সাহেবও তাই। তাঁকে আপনি যত গালমন্দ বা সমালোচনা করেন না কেন, মানতে হবে দশকের পর দশক ধরে তিনি মিডিয়া জুড়ে আছেন। কত নেতা এলো গেলো। কত জনের পতন আর উঠে আসা দেখলাম। এই এরশাদ সাহেব কিন্তু আগের মত আছেন। তাঁর মত বিনোদন আর আনন্দের উৎস দেশজ রাজনীতিতে আর একজন ও নয়।
বলছিলাম আনন্দ বেদনার কথা। দেখুন, এই যে ঈদ উল আযহা পবিত্রতা আর ভালোবাসায় উদযাপিত হবার পরও তার সাথে জড়িয়েছিল উদ্বেগ। ছিল বেদনা। বলা নাই, কওয়া নাই, আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া রোহিঙ্গা সমস্যায় দেশের মানুষ বিচলিত। বিশেষত চট্রগ্রামের ওপর এ এক বড় চাপ। সরকার, রাজনীতিবিদ, মানুষ এনিয়ে আছে মহা উদ্বেগে। পাশাপাশি দেশের নাটক সিনেমা বা গানবাজনার আয়োজনগুলো এখন একপেশে। দেখলেই বলে দেয়া যায় ইনি গাইবেন, আয় তবে সহচরী, আর ইনি গাইবেন, পদ্মার ঢেউরে। আর ইনি বলবেন জীবনে তিনি কার কার কি কি উপকার করেছিলেন আর একজন বলবেন লীগ বড় না বিএনপি বড়।
নাটকগুলো পুরো দেখেনা কেউ। কারণ, সব কাহিনী এক। এমনকি ডায়লগও আপনি আগাম বলে দিতে পারবেন। এই ভয়াবহ অবস্থায় দেশ-জাতিকে বিনোদনে ভাসিয়ে নেয়া অসম্ভব। কঠিন এই কাজটি করেছেন এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান।
সামাজিক মিডিয়ায় আপনারা যত বড় বড় কথা বলেন, এত মানুষ দেশের এতকোটি মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারবেন? জনপ্রিয় নেতাদের কেউ এর সিকিভাগ মানুষের নজর কাড়তে পারবেন না। একমাত্র ক্রিকেটার ছাড়া এখন কারো পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব না। এই ভদ্রলোক গান গেয়ে তা করেছেন। তাঁর সুর গলা গায়কী খোঁজার আগে দেশের সঙ্গীত জগতের কথা ভাবুন। জোড়াতালি আর মেধাহীনতার কারণে এখন সবাই গায়। তাছাড়া সমাজে যখন গান হারাম কি না এই তর্ক ক্রমে দানা বাঁধছে তখন ড. মাহফুজুর রহমান বরং তাতে ছাই ঢেলে দিয়ে এগিয়ে এলেন।
যে যাই বলুক, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার নমুনা ও জোয়ার বোঝা যায় কতটা জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর সঙ্গীত অনুষ্ঠান। যারা বেশী বেশী বলছেন নিজেদের রুচি ও মননের কথা বলছেন, তারা আয়নায় নিজের চেহারা দেখুন। সমালোচনার আগে নিজের ভুমিকা ও সাহস ঝালাই করুন।
গান হয়েছে, কি হয়নি সে বিচার যাদের হাতে, তারা যখন ভৃমিকা পালনে নীরব, তখন গান নিয়ে অন্যদের ঘ্যানঘ্যান নিন্দনীয়। কি মুশকিল, মানুষ খুন করলে, রেপ করলে বা চুরি করলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারা উচিৎ, সেটা না করে গান ও গায়কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণ কি?
ঈদ আনন্দে দেশ ও দেশের বাইরের বাংলাদেশীদের ডুবিয়ে রেখেছিলেন আপনি। সব ভুলে মানুষের দেখা ও আলোচনার ঝড়ে আপনিই জয়ী ড. মাহফুজ। গান জয়ী হোক।
লেখক : সিডনী প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ