পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান রোহিঙ্গা ইস্যুতে আঞ্চলিক রাজনীতি জটিল হওয়ার আশঙ্কা
উম্মুল ওয়ারা সুইটি : মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতায় বাংলাদেশ, চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ আঞ্চলিক রাজনীতি আরও জটিল হবে বলে আশংকা প্রকাশ করছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগামিতে গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়বে বলে মনে করছে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুকে বাংলাদেশকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
জানা গেছে, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় কমিশন, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে গত এক সপ্তাহ ধরে। এরমধ্যে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহল বলছে, রোহিঙ্গা বিষয়টি এখন শুধুই মিয়ানমার আর বাংলাদেশের মধ্যে নেই। এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও সচল হয়ে উঠেছে। আর এই ঘটনায় সবচেয়ে বেকায়দায় পড়বে বাংলাদেশ। একদিকে বিশাল এই জনগোষ্ঠীর চাপ, অন্যদিকে আঞ্চলিক রাজনীতি জটিল হওয়ার সম্ভাবনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি সতর্কতার সঙ্গে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পারে তাহলে দীর্ঘস্থায়ী ঝামেলায় পড়বে।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, রোহিঙ্গা বিষয়ে অনেকেই রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হতে পারে। বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকবে কি থাকবে না তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ডোকালাম নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের উত্তপ্ত সম্পর্ক এবং চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক নিয়ে ভারত সরকার ধীরে চলো নীতিতে রয়েছে। এদিকে মুসলিম বিশ্ব রোহিঙ্গা বিষয়কে দেখছে আরেকটু অন্যভাবে। আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো দেখছে চরম মানবিক বিপর্যয় হিসেবে। তাই সবাইকে নিয়েই বাংলাদেশকে এই জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
গতকাল এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আরো বলেছে, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এক জটিল অবস্থায় পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেছেন মুখপাত্র হিদার নুয়ার্ট। বিবিসি গতকাল এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদা ইয়েমেন শাখাসহ বিভিন্ন ইসলামী জিহাদী গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারকে হুমকি দিচ্ছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের একটি সম্পাদকীয়তেও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যুটি রাজনীতিতে ভয়াবহ রূপ নেবে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে পর্যায়ক্রমে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে বলে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ‘বেঙ্গলি’ উগ্র বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনস’ চালাচ্ছে। এখানে বেঙ্গলি বলতে মিয়ানমার সরকার প্রবেশকারী বিদেশি রোহিঙ্গাদের বুঝিয়ে থাকে। (অর্থাৎ তারা বাংলাদেশি এমনটা বুঝিয়ে থাকে)। তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না সেদেশের সরকার। মিয়ানমারে নিয়োজিত মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিউর ইয়াঙ্গি লি বলেছেন, এখন উচিত পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের মূল নেত্রীর (সুচি) হস্তক্ষেপ করা। আমরা যে কোনো সরকারের কাছ থেকে এমনটা প্রত্যাশা করি।
লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার কলামনিস্ট জর্জ মনবায়োত লিখেছেন, আমি মনে করি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অতিরিক্ত ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে এবং তাদের ওপর অং সান সু চি কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ চর্চা করেন না। আমি মনে করি, তার পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। এই নৃশংসতা থেকে তিনি নিজেকে সরাসরি বিরত রাখতে বেশ কিছু প্র্যাকটিক্যাল ও আইনি ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে পারতেন। তার হাতে অন্তত একটি অবাধ ক্ষমতা আছে। তা হলো কথা বলার ক্ষমতা। দ্য ইন্টারসেপ্টে মেহদী হাসান লিখেছেন, নীরবতা হলো সু চির পাপ। আবার নীরবতাকে গবেষণায় নিরপেক্ষতা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু অং সান সু চির অবস্থানকে কোনোভাবেই নিরপেক্ষতা বলা যায় না। তিনি পক্ষ বেছে নিয়েছেন। সেই পক্ষ হলো বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ এবং একেবারে ইসলাম বিরোধিতা।
বাংলাদেশে কাজ করা মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ফোরটিফাই রাইটস এর প্রতিষ্ঠাতা ম্যাথিউ স্মিথ সিএনএন’কে বলেছেন, মিয়ানমারের সহিংসতা যেহেতু অব্যাহত আছে, তাই এ সঙ্কট আঞ্চলিক অগ্নিকু-ে রূপ নিতে পারে। শান্তিপূর্ণ একটি সমাধান খোঁজার পরিবর্তে সুচির অফিস তা বন্ধে কিছুই করছে না। শুধু তা-ই নয়, অন্যভাবে বলা যায়, তারা আগুনে ঘি ঢালছে ।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নিরাপত্তা, মানবিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘর মহাসচিব অ্যান্ডনিও গুতেরা। তিনি সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেছেন, এতে উগ্রপন্থার আরো বিস্তার ঘটবে শুধু। অব্যাহতভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি খবর পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটি আঞ্চলিক অস্থিরতার একটি অনস্বীকার্য ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আনুষ্ঠানিকভাবে নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টের কাছে আমার উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখেছি ও এই সহিংসতার সমাপ্তি টানতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের প্রস্তাবও রেখেছি। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, মিয়ানমারে সরকারকে এ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সহিংসতার এই বিদ্বেষপূর্ণ চক্রের অবসান ঘটাতে হবে। পাশাপাশি যাদের দরকার তাদেরকে নিরাপত্তা ও সহায়তা প্রদান করতে হবে। সম্পাদনা : গিয়াস উদ্দিন আহমেদ