রোহিঙ্গা সংকট : সমাধানসূত্র কী?
মোহাম্মদ সেলিম রেজা
মিয়ানমারে চলছে গণহত্যা। দেশটির সামরিক বাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা অবাধে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের ধোয়া তুলে তারা নিরীহ মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুদের গুলি করে, কুপিয়ে এবং আগুন দিয়ে নির্মমভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে। নারী ও শিশুদের ধর্ষণ করছে। বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নির্যাতনের ভয়াবহতায় প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বাড়ছে বাংলাদেশে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র তথ্য অনুযায়ী ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত দেড় লাখ রোহিঙ্গা তাদের দেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ২৬০০ ঘরবাড়ি। দুই দেশের নোম্যান্সল্যান্ডে খোলা আকাশের নিচে অর্ধাহারে-অনাহারে আতঙ্কে কাটাচ্ছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এত কিছুর মাঝেও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও নোবেল জয়ী অং সান সু চি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের রক্ষা করা হচ্ছে, সন্ত্রাসীদের স্বার্থ রক্ষায় ভুল তথ্য প্রদান করা হচ্ছে।’ বাস্তবচিত্র বলছে ভিন্ন কথা। রোহিঙ্গাদের বর্বরোচিত হত্যা, ধর্ষণ ও যত্রতত্র পড়ে থাকা বিকৃত মৃতদেহের ভিডিও ও ছবি বিভিন্ন সোস্যাল মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আসিয়ান, ওআইসিসহ ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, মালদ্বীপ গণহত্যা বন্ধে অব্যাহত আহ্বান জানাচ্ছে যা উপেক্ষা করে চলেছে মিয়ানমার। ইতোমধ্যে মালদ্বীপ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান একে ‘গণহত্যা’ উল্লেখ করে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সর্বাত্মক সহায়তার অঙ্গীকার করেন। রাশিয়ায় প্রায় ১১ লাখ মানুষ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভ হয় ভারতের কলকাতায়। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় পার্লামেন্টের বাইরে, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা ভালো মানুষ। তারা শান্তিপ্রিয়। খ্রিস্টান না হলেও তারা আমাদের ভাই। যুগ যুগ ধরে তারা নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে।’ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো বলেন, ‘মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দা নয় অ্যাকশন দরকার।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেনতো মারশুদি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান নিয়ে মিয়ানমারে যান। তারা দেশটির ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ১৩ জন নোবেলজয়ীসহ ১০জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পত্র দিয়েছেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের বাংলাদেশের নাগরিকরা দ্বিধাবিভক্ত। এক দল বলছে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না; আরেক দল বলছে, বাংলাদেশের উচিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হল, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গা ইস্যুর কোনো সমাধান নয়। দুর্বল-দরিদ্র অর্থনীতি ও অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গা উদ্বস্তুদের আশ্রয় দেওয়াটা বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা দু‘পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর। নিপীড়িত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা সহজেই বাংলাদেশের মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বাংলাদেশে অবস্থানরত স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো এদের জঙ্গি হিসেবে রিক্রুট করে। এদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মীদের একটি বড় অংশ এখন রোহিঙ্গা। এছাড়া, নতুন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে মিয়ানমার; কারণ, তখন তাদের রোহিঙ্গাহীন দেশ গড়ার স্বপ্নপূরণ হবে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিকে এ ‘মানবিক বিপর্যয়ের’ দায় নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াও এই ইস্যুর কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ