আমেরিকার নতুন আফগান নীতি
(শেষ পৃষ্ঠার পর) ন্যাটো বাহিনী ও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা ও সামরিক পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। বলা যায় ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এক টিলিয়ন ডলার ব্যয় এবং আফগানিস্তানের পাহাড়ের খাদে ও ভুট্টা ক্ষেতে কয়েক হাজার ন্যাটো এবং আমেরিকার সেনা সদস্যের প্রাণহানি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে উদ্ভূত পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে মোল্লা ওমরের সৃষ্ট লেগেসি তালেবান শাসন আবার আফগানিস্তানে ফিরে আসতে পারে, আর নয়তো নিদেন পক্ষে সে দেশের বিরাট একাংশ তালেবানদের শাসনাধীন থাকবে এবং সেখান থেকে পুনরায় মোল্লা ওমর ও ওসামা বিন লাদেনের মতোই যারা বিশ্বে আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হবে নতুন নতুন জিহাদি গোষ্ঠী, যেমনটি ঘটেছিল ১৯৯৮ সালের আগস মাসে যখন লাদেনের হুকুমে সোমালিয়ায় আল শাবাব বাহিনী আফ্রিকার কেনিয়া ও তানজেনিয়ার রাজধানীতে আমেরিকার দূতাবাস ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কয়েক শত মার্কিন নাগরিককে হত্যা করেছিল। অর্থাৎ আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখন আবার সেই আগের পর্যায়ে চলে যাবার আশঙ্কা করছেন আমেরিকার সমর বিশারদগণ। এমতাবস্থায় ট্রাম্প আফগানিস্তানে সেনা সংখ্যা বাড়ানোর ঘোষণা দিলেন। এটিকে কৌশলগত শক্তি বৃদ্ধির বাস্তব নীতিমালা হিসেবে অবিহিত করছেন আমেরিকার থিঙ্কট্যাংকগুলো। তাই বিশ্বের বিশ্লেষকদের সামনে এখন বড় প্রশ্ন, আমেরিকার নতুন নীতি আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে কতটুকু স্থিতিশীল করতে পারবে এবং তাতে আমেরিকার লক্ষ্যইবা কতটুকু অর্জিত হবে। এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার পূর্বে আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর সামান্য আলোকপাত প্রয়োজন। বলা যায় দেশটির এক তৃতীয়াংশ ভূ-খন্ড এখন তালেবানদের দখল ও নিয়ন্ত্রণে। সব চাইতে দামি মাদক হিরোইন তৈরির কাঁচামাল অপিয়াম উৎপাদনের বিশাল উর্বর ক্ষেত্র এখন তালেবানদের দখলে আছে। সেখান থেকে তালেবানরা প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে। রাজধানী কাবুলের খোদ গ্রিনজোনের ভেতরে ঢুকে কয়েকদিন পরপরই বিশাল ক্ষমতাসম্পন্ন বোমার বিস্ফোরণ তারা ঘটাতে পারছে। প্রতিনিয়তই শত শত মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে অনেক সদস্য তালেবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং পরোক্ষভাবে তাদেরকে সহযোগিতা করছে। এটা এখন ওপেন সিক্রেট, যুক্তরাষ্ট্রসহ সকলে জানে। এই তালেবান বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সর্মথন দিচ্ছে পাকিস্তান। অন্য কথায় বলা যায় আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে পাকিস্তান। তালেবানের বাইরে ইরাক-সিরিয়া ভিত্তিক আইএস বাহিনীও আফগানিস্তানে সক্রিয় আছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ইরাক ও সিরিয়া থেকে সম্পূর্ণ উৎখাত হলে অন্যতম বিকল্প হিসেবে আফগানিস্তানের একটা নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড দখল করে সেখানে নতুন খেলাফতের ঘোষণা দিতে পারে আইএস। এই রকম পরিস্থিতিতে আমেরিকার নতুন সৈন্য মোতায়েন ও নীতিমালা কতটুকু কি ফল দিতে পারে। একটি বিষয়ে বিশ্লেষকগণ একমত যে, আপাতত হয়তো আফগান সরকারের পরাজয় রোধ এবং তালেবান জঙ্গিদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে। তবে প্রত্যাশিত স্থিতিশীল আফগানিস্তান ও জঙ্গি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ, এর পূর্বে ২০০১ সাল থেকে ১২-১৩ বছর এক লাখ মার্কিন সেনা ও ৪০ হাজার ন্যাটো বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রত্যাশিত ফল দিতে পারেনি, বরং পূর্বের অবস্থা ফিরে আসার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রধান ও এক নম্বর কারণ পাকিস্তান। কেন পাকিস্তান, তার কিছুটা উপরে উল্লেখ করেছি। সব জেনেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমেরিকা শক্তিশালী কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি বর্ক্তৃতায় বলেন, তালেবানদের প্রতি পাকিস্তানের সহযোগিতা ও সমর্থন প্রত্যাহার হলে এক মাসের মধ্যে আফগানিস্তানে শান্তি ফিরে আসবে। এ কথা আমেরিকাও জানে। কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক কারণে কিছু হুমকি-ধমকি ছাড়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ কঠোর পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র নিতে পারছে না। পাকিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এখন এমনই অবস্থা, না পারছে ছাড়তে, না পারছে রাখতে। নিজেদের ভুল নীতির কারণেই আমেরিকা এখন উভয় সংকটে পড়েছে। পাকিস্তানের পরমাণুু অস্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। ২০০১ সালে পরপর আমেরিকা ইচ্ছা করলে পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দিতে পারত, যেমনটি ১৯৮১ সালে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছিল ইসরাইয়েল। তাহলে অন্তত একটি আশঙ্কা থেকে যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত থাকতে পারত। আমেরিকার জন্য পাকিস্তানকে ত্যাগ করার দ্বিতীয় বড় ঝুঁকি হলো, বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিলে পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে চীনের করতলে চলে যাবে, যা আমেরিকার বৃহত্তর স্ট্র্যাটেজির জন্য ক্ষতিকর। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন আফগান কৌশলে এমন কোনো সঞ্জীবনী নেই, যা দিয়ে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে এই অঞ্চলের জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের ভেতরে আনতে হবে। এই অঞ্চলের তিনটি দেশ, অর্থ্যাৎ ভারত, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান একই সঙ্গে সরাসরি জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত। এই তিন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জঙ্গি তৎপরতাকে ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখলে তা কখনো কোনো দেশের জন্য স্থায়ী সমাধান দিবে না। অর্থনৈতিক অবরোধ পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত আমেরিকাকে নিতে হবে। ভারত ও আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীন আপাতত পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিলেও অচিরেই চীন বুঝতে পারবে জঙ্গিবাদ এমনই সর্প, সে কারো বন্ধু হতে পারে না। চীনের বৃহত্তম জিনজিয়াং প্রদেশে ইতিমধ্যেই জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। তাই পাকিস্তান মোল্লা ও মিলিটারির কবল থেকে মুক্ত হতে না পারে তাহলে সেটি চীনের জন্যেও কাল হয়ে ওঠবে, সেদিন বেশী দূরে নয়। এই অঞ্চল থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হলে অন্তত এই একটি ইস্যুতে আমেরিকা ও চীনকে একই নৌকায় ওঠতে হবে। তবে বলা যত সহজ বাস্তবতা তার চাইতে অনেক কঠিন। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূ-রাজনীতির খেলার গুটিতে পরিণত হয়ে বিশাল সম্ভাবনাময় আফগানিস্তান আজ নিঃশেষ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একই সঙ্গে সেটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে করে তুলছে অস্থিতিশীল।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক