সততা চর্চা, ইসলাম এবং আমরা
মাহফুজ আল মাদানী
সত্যবাদিতা। সত্য কথা বলার অভ্যাসকে সত্যবাদিতা বলে। পরিভাষায়, ‘ব্যক্তির কথার সঙ্গে তার অন্তরের এবং বাস্তবতার মিল থাকলে তাকে সত্য কথা বলে’। সত্যবাদিতা একটি মহৎ গুণ। আর এ সত্য কথা হওয়ার জন্য মুখের কথার সঙ্গে অন্তরের মিল থাকা এবং কথার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকা আবশ্যক। সত্য প্রশান্তির নাম। হাদিসের বাণী, ‘হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অবগত হয়েছি, তিনি এরশাদ করেন, তুমি সন্দেহযুক্ত কথা ও কর্ম ছেড়ে যাতে সন্দেহ নেই সেদিকে ফিরে যাও। নিশ্চয়ই সত্য প্রশান্তির নাম এবং মিথ্যা সন্দেহ ও অশান্তির নাম’ -(তিরমিজি, আত তারগীব ওয়াত তারহীব)। সত্যবাদিতা মানুষকে জান্নাতের পথ দেখায়। দেখায় মুক্তির পথ। পবিত্র ধর্মে ইসলামে সত্য কথা বলার জন্য আদেশ করা হয়েছে। মহান রাব্বুল আলামিন আদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’ -(সুরা আল আহযাব: ৭০)।
একজন মানুষ সমাজে তখনই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, যখন সে হয় সত্যবাদী। সত্যবাদী মানুষ সর্বদা সবার কাছে প্রিয়ভাজন। সত্যকথা বলার মাধ্যমে পায় সে মুক্তির পথ। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘ সত্য মুক্তি দেয়’ -(মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি, ইবনে হিব্বান)। আমরা যার আদর্শে আদর্শিত হতে চাই, আমাদের সেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো সত্য বলাকে বর্জন করেননি। সদাসর্বদা সত্যের উপর ছিলেন অনড়, অটল। তাই তো তিনি ‘সত্যবাদী’ হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। আজ আমাদের সমাজে ‘আল-আমিন’ ‘সত্যবাদী’ উপাধী দেওয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। সভায়-মঞ্চে, কথায়-কাজে, ফোনালাপে সর্বত্রই মিথ্যার ব্যবহার। নির্বাচনি মঞ্চে নেতা-নেত্রীদের মিথ্যার ফুলঝুরি শুনতে পাই। অথচ সেই মহামানব সত্য কথা সম্পর্কে উৎসাহিত করেছেন জীবনভর। আল্লাহ তায়ালাও সত্যবাদীকে পুরস্কৃত করবেন। মহান আল্লাহ তায়ালা সত্যের পুরস্কার সম্পর্কে এরশাদ করেন, ‘(তোমরা সত্য কথা বললে) তিনি তোমাদের আমলকে পরিশুদ্ধ করবেন তথা নেক আমল করার তাওফিক দিবেন এবং তোমাদের গুনাসমূহ ক্ষমা করবেন’ -(সুরা আল আহযাব : ৭১)।সত্য কথা কল্যাণের পথ দেখায়, দেখায় জান্নাতের পথ। তাই তো প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য কথা বলার জন্য নির্দেশ করেছেন। ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা সত্য কথা বলো। কেননা, সত্য নেকের পথ দেখায়, আর নেক জান্নাতের পথ দেখায়। কোনো ব্যক্তি যখন সত্য কথা বলতে থাকে এবং সত্য অনুসন্ধান করতে থাকে তখন সে আল্লাহর নিকট সিদ্দিক (সত্যবাদী) হিসেবে গণ্য হয়ে যায়’ -(মিশকাতুল মাসাবিহ)। অপর হাদিসে এসেছে, ‘হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা সত্য গ্রহণ কর। সত্য নেকির সঙ্গে রয়েছে। আর উভয়টি জান্নাতে যাবে। আর মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। মিথ্যা পাপের সঙ্গে রয়েছে। উভয়ই জাহান্নামে যাবে’ – (ইবনু হিব্বান, আত তারগীব ওয়াত তারহীব)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সত্যবাদীদের সঙ্গী তথা সত্যবাদী হওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করে বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও’ -(সুরা আত তাওবাহ : ১১৯)। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, যখন তোমার মাঝে চারটি জিনিস থাকবে, তখন দুনিয়ার সবকিছু হারিয়ে গেলেও তোমার কোনো সমস্যা হবে না। ১. আমানত রক্ষা করা। ২. সত্য কথা বলা। ৩. সুন্দর চরিত্র। ৪. হালাল রুজি।’ -(আহমদ, আত তারগীব ওয়াত তারহীব)। সত্যবাদী লোককে সবচেয়ে উত্তম মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হাদিসের ভাষ্যমতে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হলো সবচেয়ে ভালো মানুষ কে? তিনি বললেন, প্রত্যেক হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত অন্তরের অধিকারী এবং সত্য কথার অধিকারী ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম মানুষ’ -(ইবনে মাজাহ)।
প্রখ্যাত ওলী হজরত জুনায়েদ আল বাগদাদী (রহ.) বলেন, ‘সত্য সকল কিছুর মূল’। তিনি আরও বলেন, ‘সত্য হলো মূল, আর ইখলাস হলো তার শাখা’। সত্য সবসময় কল্যাণের পথ দেখায়, দেখায় আলোর পথ। সত্যবাদী মানুষ সমাজ, দেশ, জাতি সকলের জন্য মঙ্গলজনক। তাদের মর্যাদা সর্বাগ্রে সবার উপরে।
আমাদের সমাজে সত্যবাদী লোকের সংখ্যা নিতান্তই খুব কম। সত্যবাদী লোক ছাড়া সমাজে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। আর যাই হোক না কেন মিথ্যাবাদী লোকের মাধ্যমে সমাজ আদর্শময় হয়ে উঠবে না। তাই প্রয়োজন সত্যবলা আর সত্যবাদী লোকের। আমরা কি পারি না মিথ্যার পরিবর্তে সত্য কথা বলতে? সত্যকথা বলতে বাধা কোথায়? একটু সদিচ্ছা থাকলে সত্য বলা সম্ভব। সম্ভব নিজেকে পরিবর্তন করা, সঙ্গে সঙ্গে সমাজকেও। আমরা আমাদের সমাজে যদি সত্যকে গ্রহণ আর মিথ্যাকে বর্জন করি তাহলে সমাজ কি ‘আদর্শ সমাজ’ হয়ে উঠবে না?
লেখক: এম. ফিল গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান