ধর্ষণের ঘটনা কেন দিনদিন বাড়ছে?
ইয়াসমিনের কথা আমরা অবশ্যই ভুলে যাইনি। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কিশোরী মেয়েটি কাজ শেষে ফিরতে চেয়েছিল গ্রামে, মায়ের কাছে। নরপশুরা ধর্ষণ ও হত্যা করে তাকে। ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটল জাকিয়া সুলতানা রূপার; ইয়াসমিনের মতো এ নামটি এখন সকলের পরিচিত। সভ্য মানুষ হিসেবে মনে করেই রূপা সকলের মতো বাসে উঠেছিলেন তিনি। পরিশ্রমী, মেধাবী রূপার অপার সম্ভাবনা ছিল। অন্যদের মতো একজন নারী, যে শিক্ষক হতে চেয়েছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। স্বাধীন দেশে আর দশজন মধ্যবিত্ত মানুষের মতো পাবলিক বাসে করে গন্তব্যে পৌঁছতে চেয়েছিল। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য ‘নিরাপদ’ নামের একটি বাসে ধর্ষণের শিকার হয় রূপা। রূপাকে বাসে বসেই গণধর্ষণ করে মাথা থেঁতলে হত্যা করে বাসের চালক, সুপারভাইজার, কন্ডাক্টররা। রূপাকে বহণকারী বাসের নাম ‘নিরাপদ’। বাসে লেখা ছিল ‘গড বে¬স ইউ’। সবচেয়ে অনিরাপদ বাসটির নাম ‘নিরাপদ’। ‘নিরাপদ’ ও ‘গড বে¬স ইউ’ সে বাসেই ঘটে গেল সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা। আগেই বলেছি নাম দিয়ে সভ্য চেনা যায় না। যেখানে বাসটির নাম ‘নিরাপদ’ ছিল। রূপা নিরাপদ বাসেই অনিরাপদ হয়েছিল। পাঁচজন পুরুষ। কারও মনেই এতটুকু দয়ামায়া জাগল না? এদের অনেকেই বিবাহিত ছিল। গণধর্ষণ দিয়েই শেষ হয়ে যায়নি। ধর্ষণ শেষে ঘাড় মুরিয়ে রূপাকে নৃশংসভাবে রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এরা সবাই রাতে বাড়িতে স¦জনদের কাছে যায়। বাড়িতে গিয়ে কেউ আদরের মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে। কেউ মা, বোন, স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেছে। ওই সময় এতটুকুও ভাবল না, ‘আমার মেয়ের মতো এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছি, আমার বোনের মতো এক বোনকে ধর্ষণ শেষে নৃশংসভাবে হত্যা করেছি’। রূপাকে দেখে এদের কাউকে মনে পড়েনি? মনে হয়নি কাল রূপার জায়গায় এদের যে কেউ হতে পারে? আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন ধর্ষণ; এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। প্রশ্ন জাগে আমরা কি আসলে মানসিক রোগী হয়ে গেছি? কতিপয় পুরুষদের কি মনুষ্যত্ব বিকৃত হয়ে গেছে? ওই সকল পুরুষরা কি পশুত্ব বরণ করেছে? ওই সকল মানসিক রোগী ও পশুত্ব বরণকারী পুরুষ আকৃষ্ট হয়েছে ধর্ষণে। তারা শিখে গিয়েছে কী করে ধর্ষণ এবং নৃশংসতা একইসঙ্গে চলন্ত বাসের ভেতর করতে হয়। গণধর্ষণ করে কী করে ধর্ষিতাকে মেরে ফেলতে হয়, কি করে ধর্ষণের আলামত বা প্রমাণ নষ্ট করতে হয়। ভারতের জ্যোতি সিংকে ফেলেছিল রাস্তার কিনারে, রূপাকে ফেলেছিল জঙ্গলে। রূপার ধর্ষকরা রূপার মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে ফেলে দেয় জঙ্গলে। একটি ঘটনা বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে, অন্যটি ভারতের দিল্লিতে। একটিতে ধর্ষকরা হিন্দু, ধর্ষকদের শিকারও হিন্দু। আরেকটিতে দুপক্ষই মুসলিম। ধর্ষণ সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব ভাষার, সব দেশের, সব সংস্কৃতির মানুষই করে। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই করে। আজ কোথাও শিশু ধর্ষণ ঘটলে পরপর অনেকগুলো শিশু ধর্ষণ ঘটবে। তারই ধারাবাহিকতায় গত কয়েকদিন ধরে ধর্ষণের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। ওই সকল কতিপয় পুরুষদের যৌন চরিতার্থ মেটানোর জন্য রেহাই পায়নি ঈদের দিনেও। পটুয়াখালীর বাউফলের ২২ বছরের একটি মেয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে যাওয়ার পথে চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়। ঈদের আগের দিন গাইবান্ধার ফুলছড়ির মাত্র ৮ বছরের সিনথিয়াকে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বরগুনার বেতাগীতে নারী শিক্ষককে বিদ্যালয়ে ধর্ষণ, একই জেলার পাথরঘাটা উপজেলা মামা কর্তৃক ভাগ্নি ধর্ষণ। সব মিলিয়ে আমাদের দাবিদার এ সভ্য সমাজে কি জানান দিচ্ছে?
সারাবিশ্বে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে নিরবধি ঘটেই চলেছে। নারীবিদ্বেষ এত চরমে উঠেছে, যে, ঘরে বাইরে, রাস্তা ঘাটে, ট্রেনে বাসে নারীকে ধর্ষণ আর খুন করেই চলেছে পুরুষেরা। লোকে মন্দ বলুক, আদালত শাস্তি দিক, তাতে কি কারও কিছু যায় আসে না? সকলেই ভাবে অনেকে যেমন অপরাধ করেও ধরা পড়ে না, তারাও তেমন ধরা পড়বে না। কেউ কেউ হয়তো ভাবে, ধরা পড়লেও ছাড়া পেতে আর কতক্ষণ! টাকা পয়সা ঢাললেই সাত খুন মাফ। বিচারহীনতার কারণেই হয়তো ধর্ষণের মতো অপরাধ করে সহজেই অপরাধীরা পার পায়।
লেখক: সাংবাদিক/সম্পাদনা: আশিক রহমান