রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ফলে সমাজে যে প্রভাব পড়তে পারে
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এদেশে প্রবেশের কারণে সমাজে একটা নেতিবাচক বড় প্রভাব পড়বে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে মানবিকতার দিক, আরেকটি হচ্ছে নিরাপত্তার দিক। আমি মনে করি, বাংলাদেশ মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছে। যেভাবে রোহিঙ্গারা গণহত্যার ও নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে একটি বিশাল সংখ্যায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তাদের বাংলাদেশ খাদ্য ও আশ্রয় দিচ্ছে।
এটা কোন বাংলাদেশ দিচ্ছে? যে বাংলাদেশ নিজেই একটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বন্যা কবলিত অবস্থায় আছে, যে দেশের এখনো খাদ্য আমদানি করতে হয়। এরকম একটা দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা এই মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছি। এটা খুব স্বাভাবিক, আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি অনুযায়ী আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। আশ্রয় ও খাদ্য দিয়েছি, মানবতার দিক থেকে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে, এই যে মানবতা দেখালাম, আশ্রয় দিলাম, এরপর বাংলাদেশ কিভাবে এই সংকট কাটিয়ে উঠবে? অনেকেই বলছেন, রোহিঙ্গাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বিধায় তারা আসছে। আমার প্রশ্ন, একইভাবে কি বাংলাদেশেরও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে না? মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশে যদি এইভাবে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে, তাহলে আমরা কতদিন পর্যন্ত আমাদের নিজেদের খাবার এই বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের মুখে তুলে ধরতে পারব? আশ্রয় দিতে পারব? এটা আমাদের অর্থনৈতিক অঙ্গনে এবং পরিবেশে বিরাট একটা প্রভাব সৃষ্টি করবে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এই সব অঞ্চলের পাহাড়ে, বনে জঙ্গলে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা।
এটা পরিবেশের উপর একটা প্রভাব বিস্তার করছে এবং পর্যটন শিল্প ধ্বংস হচ্ছে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে আমাদেরও রোহিঙ্গাদের শারীরিক গঠন এক। চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের অনেক মিল পাওয়া যায় এবং আমাদের ধর্মের সাথেও তাদের মিল রয়েছে। তারাও ইসলাম ধর্ম অনুসারী। যারা আমাদের দেশে নানা ধরনের রাজনৈতিক খেলা খেলতে চায়, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করতে চায়, তাদের কাছে এটা একটা বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করেছে।রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তারা এই সুযোগটা নিতে পারে। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চায়, যারা বিভিন্ন জঙ্গিবাদের মদদদাতা তারা কিন্তু এটাকে ব্যবহার করবে। শুধু তাই নয়, যেহেতু রোহিঙ্গারা দেখতে আমাদের মতো, ভাষাগত মিল আছে, তারা কিন্তু ফেক পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এরকম অপরাধমূলক কর্মকা- আরও আগে থেকেই হয়েছে। এখন আবার সামনে দেশের জাতীয় নির্বাচন। এখন যদি এই চার পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থাকে, তারা যদি অনিবন্ধিত থাকে এবং এদের যদি ভুয়া ভোটার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এতে বিরাট একটা রাজনৈতিক প্রভাব পড়বে আমাদের দেশে। একটা জাতির সবাই ক্রিমিনাল নয়, রোহিঙ্গারাও সবাই ক্রিমিনাল নয়। যেহেতু রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে হারিয়ে এসেছে, এখন এই সর্বস্ব হারানো ছেলেটা বা মেয়েটা যদি জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাদের যদি জঙ্গিবাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়, এটা তো একেবারে অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এতে বাংলাদেশে যে একটা ধর্মীয় সম্প্রীতি আছে, সেটার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। বৌদ্ধের বিরুদ্ধে মুসলমান দাঁড়াবে, মুসলমানের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ যাবে। একটা সাম্প্রদায়িক সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। একটা বিরাট নৈরাজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে একটা প্রভাব আমাদের সমাজে পড়বে। এটাকে তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না।
পরিচিতি: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি
সম্পাদনা: আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ