২৪ বছর পরের বাংলাদেশ : আমরা ও মালয়েশিয়া
দেশ তখন উত্তাল। ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলনের রেশ তখনও কাটেনি। আবার ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের চলছে প্রস্তুতি। এই দুই আন্দোলনের মাঝে ১৯৬৮তে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগে। অজ পাড়াগাঁয়ের গন্ধ তখনো শরীরে লেগে ছিল। যা দেখতাম তা-ই বিস্ময়ের সাথে গ্রহণ করতাম। অনেক প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি মনে। তখন অবাক হয়ে দেখতাম কত কত নাক-চ্যাপ্টা ছাত্র কলা ভবনের লনের উত্তর পাশের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে ঢুকছে, বের হচ্ছে। অনেকে কলা ভবনের সামনের লনে হাঁটছে। কারও গায়ের রং ফর্সা, কারওটা কিছুটা তামাটে কিন্তু নাক ঠিকই চ্যাপ্টা। জিজ্ঞেস করে জানলাম এরা এ দেশের কেউ নয়, এরা এসেছে সে-ই সুদূর মালয়েশিয়া আর থাইল্যান্ড থেকে। কেউ ডাক্তারি পড়ছে আর কেউ পড়ছে ইঞ্জিনিয়ারিং।
এখন ফিরি মূল কথায়। যে মালয়েশিয়া থেকে দলে দলে শিক্ষার্থী আসত আমাদের দেশে, সেই মালয়েশিয়ায় এখন দলে দলে যাচ্ছে এদেশের শিক্ষার্থীরা। কেন? দেশটি এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বেশ কয়েক হাজার বাংলাদেশি ‘সকেন্ড হোম’ (দ্বিতীয় আবাসস্থল) গড়ার লক্ষে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪৭ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এত লোভনীয় এখন সেই দেশ। মালয়েশিয়া এরূপ হলো কী করে? কারণ মাহাথীর নামক এক অভাবিত ভিশনারি ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তি নয়, আসলে একজন দুঃসাহসী দেশপ্রেমিক নেতা। এমন নেতা যিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দিলেন, আমি শুধু রাজধানী কুয়ালালামপুর নয়, পুরো মালয়েশিয়াকে তিলোত্তমা বানাবো। ঘোষণা দেওয়া আর ঘোষণা কার্যকর করা যে এক জিনিস নয় হয়তো তিনি তা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি। চারদিক থেকে আসতে থাকল বাধার পর বাধা। শক্ত বাধা আসলো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশের নেতাদের কাছ থেকে। নিজ দেশের ভেতরে তো বিভীষণরা ছিলই। বুঝে ফেললেন তিনি কী করা দরকার তার। প্রকাশ্যে জানিয়ে দিলেন, তোয়াক্কা করেন না তিনি কোন হুঙ্কার কিংবা প্রতিবন্ধকতাকে। কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি দেখিয়ে দিলেন, পাশ্চাত্যের সাহায্য ছাড়াই কীভাবে একটি সঙ্কটাপন্ন দেশকে অন্যতম উন্নত দেশে উন্নীত করা যায়। পুরো দেশটার আদলই তিনি বদলে দিলেন সকল নাগরিককে সাথে নিয়ে, শুধু বিভীষণদের বাদ দিয়ে, প্রয়োজনে জেলে পুরিয়ে। বিশ বছর একাধারে দেশ চালিয়ে উন্নয়নের পরাকাষ্ঠা দেখানো মাহাথীর মোহাম্মদকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি শহর থেকে এত দূরে কেন কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট নির্মাণ করলেন যেখানে শহর থেকে যেতে মানুষের অনেক সময় লাগে? জবাবে তিনি নাকি বলেছিলেন, একশত বছর পরের মালয়রা তো আমাকে কাঠগড়ায় আসামী করে জানতে চাইবে, এয়ারপোর্ট এত কাছে কেন বানালেন? বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়করা কি এমন দূরদর্শী অত্মপ্রত্যয়ী কথা বলতে পারেন? অবশ্যই পারেন। তা দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের লৌহমানব সমসাময়িক কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পশ্চিমাদের ঘৃণ্য খেলা জমে ওঠার আগেই তিনি নির্ভীক চিত্তে ঘোষণা দিলেন, আমরা পদ্মা-সেতু বানাব নিজের টাকা দিয়েই। নিব না এক টাকাও কারো কাছ থেকেই। প্রায় তিরিশ হাজার কোটি টাকার দায়িত্ব নিয়ে শুরু করলেন পদ্মাসেতু তেরির অকল্পনীয় দুরূহ কাজ। মাত্র দুবছরের ব্যবধানেই সেতু এখন দৃশ্যমান। আসলে পদ্মাসেতু তো একটি সেতু মাত্র নয়, এটি বাঙালির আত্ম-অহংকারের প্রতীক, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেকোনো অসম্ভব কিছু সম্ভব করার সাহসিকতার প্রতীক, বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের শিরদাঁড়া সোজা করে শির উঁচু করে হিমালয়সম দম্ভ নিয়ে দ-ায়মান থাকতে পারার জীবন্ত প্রেরণা। মাহাথীরের মালয়েশিয়া থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। আগে কী অবস্থায় ছিল মালয়েশিয়া? বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত কোনো উন্নতিই ছিল না। বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকলে আটকে পড়া দেশটির প্রায় সব সেক্টরই ছিল সা¤্রাজ্যবাদী শাসকদের হাতে। উৎপাদনশীল খাতের বিপুল অংশ ছাড়াও প্ল্যানটেশন খাতের ১.৪ মিলিয়ন একর ভূমির মধ্যে ১.২ মিলিয়ন একর ভূমিই ছিল বিদেশি বেনিয়াদের দখলে। তারা সব মুনাফা তাদের দেশে নিয়ে যেত। মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করতই না। মাহাথীরের আগের ইংল্যান্ডে-লেখাপড়া-করা প্রধানমন্ত্রীরা বৃটিশদের তোয়াজ করে চলতেন। তারা সবাই ছিলেনও রাজ পরিবারের আত্মীয় বলয়ের। উন্নতি নিয়ে তাদের ভাবনাও ছিল না। সাধারণ পরিবারের মাহাথীর এলেন, রাজনীতিতে জায়গা করে নিলেন, সবার মন জয় করলেন, মাঠে-ময়দানে রাজনীতি করে মালয়েশিয়ার চতুর্থ সরকার প্রধান হলেন। এসেই সব পাল্টে দেওয়া শুরু করে দিলেন। বৃটিশদের তোয়াক্কা না করে কাছাকাছি দেশ জাপানকে বন্ধু বানালেন, এই দেশটির সাহায্য নিলেন আর ধীরে ধীরে অর্থনীতির চাকা সচল করে তুললেন।
মাহাথীরের শুরু করা উনিশ শ’ আশি ও নব্বই-এর দশকের শিল্প-বিপ্লব সব কিছু পাল্টে দেয়। গ্রামের নিপীড়িত গরীব নাগরিকরা দলে দলে আসতে থাকে শহরগুলোতে। তারাই অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগিয়ে দেয়। সৃষ্টি হয় নতুন শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শিল্প-বিপ্লবের হাত ধরে এদের গৃহায়ন-এর জন্য গড়ে উঠে পেটালিং জায়া আর সুবাং জায়ার মতো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন শহর। নব্বই-এর দশকের শেষ দিকে কুয়ালালামপুর শহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায় দুটি নীলাভ গগনচুম্বি অট্টালিকা- পেট্রোনাস টাওয়ার বিশ্বের সর্বোচ্চ ইমারত। এটিও সম্ভব হয়েছিল সে-ই মানুষটিরই জন্যে, তিনি ড. মাহাথীর মোহাম্মদ যিনি লেখাপড়া করেছিলেন মেডিকেল সায়েন্সে, ছিলেন নিজ জন্মস্থান কিদাহ প্রদেশের আলোর সিতাহ এলাকার স্বনামধন্য চিকিৎসক। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের বিশ্ব-সমাদৃত প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত ড. মাহাথীর সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকদের মধ্যে সম্পদের পুনঃবন্টনের ব্যবস্থা করে কৃষকদের ভেতর পুঞ্জিভূত অসন্তোষ চিরতরে মাটি চাপা দিয়ে দেন। নবসৃষ্ট বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত জনগণের কল্যাণের বিষয়টি মাথায় রেখে শিক্ষা ব্যবস্থায় আনা হয় আমূল পরিবর্তন। কর্মমুখী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা জন্ম দেয় এক ঝাঁক সৃষ্টিশীল দক্ষ মেধাবী তারুণ্যের। এরাই পরবর্তীতে শিল্পোন্নয়নের গতিকে টেকসই করতে বিশাল ভূমিকা রাখে। সত্তরের দশকে শুরু হয় মালয়েশিয়ার বিপুল উন্নয়ন আর সম্প্রসারণ। উন্নয়নের জোয়ার আসে আশির দশকে। নববই-এর দশকে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি উঠে তুঙ্গে। এরপর আর মালয়েশিয়াকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৫৬ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করে ১৯৮১-২০০৩ পর্যন্ত দীর্ঘ বাইশ বছর দেশের শাসন-ক্ষমতায় থেকে বহু বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তিনি দেশটির পুরো চেহারাটাই পাল্টে দিলেন। ৩০ বছরের মধ্যে দেশকে পূর্ণাঙ্গ উন্নত দেশে উন্নীত করার লক্ষে তার গৃহীত ভিশন-২০২০ মালয়েশিয়ার জন্য ছিল একটি আশীর্বাদ। এই উচ্চাভিলাষী ভিশন অর্জনের জন্য প্রয়োজন ছিল বার্ষিক গড়ে ৭% জিডিপি প্রবৃদ্ধি; বাস্তবে অর্জিত হয়েছে ৯%-এর অধিক প্রবৃদ্ধি। নেতৃত্বের সদিচ্ছা থাকলে কী না হয়! দেখিয়ে দিয়েছেন মাহাথীর।
বাংলাদেশ কেন এমনটি পারবে না আগামী ২৪ বছরে? পারবে অবশ্যই। প্রয়োজন ধারাবাহিক স্থিতিশীল নেতৃত্ব, সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিষ্ঠাবান ভিশনারি নেতার সমাহার, প্রশ্নহীন সুশাসন, জঙ্গী-সন্ত্রাসীমুক্ত সমাজ, দুর্নীতিমুক্ত শোষনহীন শাসন ব্যবস্থা, গ্রামীন বাংলার সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা, শিল্পায়নের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির সম-উন্নয়ন, সময়োপযোগী কর্মমুখী প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা, ন্যুনতম পরদেশ-নির্ভরতা, সর্বোপরি শিরদাঁড়া সোজা-থাকা অকুতোভয় সামগ্রিক নেতৃত্ব। আরো প্রয়োজন জনগণের অংশগ্রহণে তৈরি কৌশলগত পরিকল্পনা, সুদক্ষ-সুনিপুণ ব্যবস্থাপনা আর পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সততার মুকুটশোভিত দেশপ্রেমিক ত্যাগী কর্মীবাহিনী। সব ঠিকঠাক থাকলে ফিনিক্স পাখির মতো মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ।
লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উ›মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়; কলামিস্ট, গবেষক ও ব্যবস্থাপনাবিদ