মদিনায় নবীজির সর্বপ্রথম জুমার খুতবা
মাহফুয আহমদ
মুহাদ্দিসগণ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছোটবড় সকল হাদিস বর্ণনার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। সেজন্য হাদিস ও সুন্নতে নববি ভা-ারে বিক্ষিপ্তভাবে নবীজি প্রদত্ত খুতবাগুলো বর্ণিত হয়েছে। সহিহ বোখারি ও সহিহ মুসলিমসহ হাদিস গ্রন্থাদিতে বহু বর্ণনার শুরুতে বর্ণনাকারী বলেন, ‘খাতাবানা’ অর্থাৎ নবীজি খুতবায় আমাদের বলেছেন অথবা ‘ক্বামা ফিনা খাতিবান’ অর্থাৎ নবীজি খুতবায় দাঁড়িয়ে বললেন। এসব বর্ণনা মূলত নবীজি প্রদত্ত খুতবাগুলোরই উদ্ধৃতি। অন্যদিকে ঐতিহাসিকগণ বিশদভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নবীজির পুরো জীবনবৃত্তান্ত সংকলন করেছেন এবং প্রাসঙ্গিক তাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে নবীজি প্রদত্ত খুতবাসমূহ স্ব স্ব স্থানে উদ্ধৃত করেছেন। আর বিদায় হজে প্রদত্ত নবীজির খুতবার পুরো অংশই একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
তাছাড়া সিরাত ও ইসলামী ইতিহাস বিষয়ক কোনো কোনো গ্রন্থে নবীজি প্রদত্ত আরও কিছু খুতবা পরিপূর্ণভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। তেমনি একটি খুতবা বিবৃত হয়েছে আল্লামা তাবারি (রহ.) এর ‘তারিখুর রুসূল ওয়াল মুলূক’ গ্রন্থে। মদিনায় এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম জুমায় যে খুতবা প্রদান করেছিলেন- তা নিম্নরূপ:
‘সকল প্রশংসা আল্লাহর। তাঁর প্রশংসা করছি। তাঁর নিকটি সাহায্য চাচ্ছি। তাঁর ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তাঁর নিকট হেদায়াত কামনা করছি। তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছি। আমি তাঁর সঙ্গে কুফরি করি না। যে তাঁর সঙ্গে কুফরি করে সে আমার শত্রু। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই।
আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাঁকে হেদায়াত, সত্য দ্বীন, আলো ও উপদেশ সহকারে নবীদের পরবর্তী বিরতিতে লোকুদের মূর্খতা ও ভ্রষ্টতার সময়ে শেষ যুগে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে প্রেরণ করেছেন। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করল সে সঠিক পথ প্রাপ্ত আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হলো সে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল।
আমি তোমাদের আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করতে ওসিয়ত করছি। এক মুসলিম অপর মুসলিমকে সবচেয়ে উত্তম যে ওসিয়ত করতে পারে তা হলো, আখেরাতের (জন্য আমলের) ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা এবং তাকওয়া অবলম্বনের আদেশ দেয়া। অতএব আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের ব্যাপারে যেসব কিছুর ভয় দেখিয়েছেন, সেসব থেকে দূরে থাকো। এরচেয়ে উত্তম কোনো নসিহত হতে পারে না। এরচেয়ে ভালো কোনো উপদেশ হতে পারে না। তাকওয়া তথা নিজ প্রতিপালকের ভীতি মনে রেখে তাঁর নির্দেশমতো আমল করা আখেরাতে ইচ্ছামত নেয়ামত পাওয়ার জন্য প্রধান সহায়ক। যে প্রকাশ্য ও গোপনে তার ও আল্লাহর মধ্যকার বিষয়গুলো দুরস্ত করে নিল এবং আমলের দ্বারা আল্লাহ ছাড়া আর কারও নিয়ত করল না, এসব তার জন্য দুনিয়াতে হবে মর্যাদা এবং মৃত্যুর পর হবে মহাসম্পদ; যখন মানুষ তার ভালো কৃতকর্মের প্রয়োজন অনুভব করবে, এতদ্ব্যতীত বাকি সবের বেলায় সে কামনা করবে তার এবং ওইসব মন্দ কর্মের মাঝে যদি বহু দূরত্ব থাকতো! আল্লাহ তায়ালা নিজের ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক করছেন। বান্দাগণের প্রতি আল্লাহ বড় দয়াবান। আল্লাহর বাণী চিরসত্য এবং তাঁর অঙ্গীকার সর্বদা বাস্তবায়িত হয়; এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি জুলুমকারী নই।’ (সূরা ক্বাফ: ২৯)
বর্তমান ও ভবিষ্যত এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সর্বক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা যে তাকওয়া অবলম্বন করল সে মহা সফলতা অর্জন করল। তাকওয়া মানুষকে আল্লাহর শাস্তি ও অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচায়।
তাকওয়া চেহারা আলোকিত করে, প্রতিপালককে সন্তুষ্ট করে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেয়। নিজেদের অংশ বুঝে নাও এবং আল্লাহর আনুগত্যে কোনো শিথিলতা প্রদর্শন করো না। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের তাঁর কিতাব শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাঁর পথ তোমাদের নিকট পরিষ্কার করে দিয়েছেন; যাতে করে সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর মাঝে ফরক করা যায়। তোমরা আল্লাহর জন্য শ্রম স্বীকার করো যেভাবে শ্রম স্বীকার করা উচিত। তিনি তোমাদের পছন্দ করেছেন এবং তোমাদের নাম দিয়েছেন মুসলমান। যাতে যে ধ্বংস হওয়ার সে যেন প্রমাণ প্রতিষ্ঠার পর ধ্বংস হয় এবং যে বাঁচার ছিল, সে যেন বেঁচে থাকে প্রমাণ প্রতিষ্ঠার পর। আল্লাহ ছাড়া আর কারও শক্তি নেই। তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করো। মৃত্যু পরবর্তী জিন্দেগির জন্য আমল করো। কেননা যে তার ও আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে নিল সে আর কোনো মানুষের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। কেননা আল্লাহ মানুষের ওপর কর্তৃত্ব রাখেন, পক্ষান্তরে মানুষ আল্লাহর ওপর কোনো কর্তৃত্ব রাখে না। আল্লাহ মানুষের সবকিছুর মালিক, পক্ষান্তরে মানুষ তাঁর কিছুরই মালিক নয়। আল্লাহ মহান। মহান মর্যাদাবান আল্লাহ ছাড়া আর কারও কোনো শক্তি নেই।’
ইমাম বায়হাকি (রহ.)ও তদীয় ‘দালায়িলুন নুবুওয়াহ’ (২/৩৮৫-৩৮৬) গ্রন্থে ভিন্ন সনদে এই খুতবাটি বর্ণনা করেছেন। হাফিজ ইবনে কাসির (রহ.) মন্তব্য করেন, এসব সনদ একটি অপরটির জন্য সমর্থনকারী এবং সবগুলো মিলে একটি শক্তিশালী বর্ণনায় পরিণত হয়েছে; যদিও শব্দের কিছুটা ব্যবধান রয়েছে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/২০)