পিতা-মাতার খেদমত মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
মহান আল্লাহ মানুষের সৃষ্টি কর্তা, পালন কর্তা ও রিজিক দাতা। সেই মহান আল্লাহ তার অপরূপ সৃষ্টি মানুষকে পিতা- মাতার মাধ্যমেই এই সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। এই পৃথিবীতে পিতা-মাতাই হচ্ছে সন্তানের সবচেয়ে বড় আপন জন। সন্তানের জন্য পিতা মাতার মত আপনজন এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কেউ নেই। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর পিতা মাতা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে সকল আরাম আয়েশ ত্যাগ করে সন্তানকে বড় করে তোলেন। বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেই মহান আল্লাহ পিতা-মাতার খেদমত করার সর্বাধিক তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তার ইবাদতের পরেই মানুষকে পিতা মাতার খেদমত করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ র ইবাদত করা যেমনি ফরজ, পিতা-মাতার খেদমত করা মানুষের ওপর তেমনি ফরজ। ইরশাদ হচ্ছে- এবং আপনার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না। পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাঁদের কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন তা হলে তাঁদের সঙ্গে “উহ’’ শব্দটিও বলোনা। তাদের ধমক ও দিয়ো না। তাদের সঙ্গে শিষ্টতাপূর্ণ কথা বলো। তাদের সামনে ভালোবাসার সঙ্গে বিন¤্র ভাবে মাথানত করে দাও এবং বলো হে পালন কর্তা তাঁদের উভয়ের প্রতি দয়া করুন, যেমনটি তাঁরা আমাদের শৈশব কালে করেছেন’ (সুরা বনি ইসরাঈল, ২৩- ২৪)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে কুরতুবীতে লেখেন – আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতের মধ্যে পিতা-মাতার প্রতি আদব, সম্মান এবং তাঁদের প্রতি সদ্ব্যবহার করাকে নিজের ইবাদতের সঙ্গে একত্রিত করে ফরজ করেছেন। যেমন সুরা লোকমানের মধ্যে মহান আল্লাহ নিজের শুকরিয়া আদায় করার সঙ্গে সঙ্গে পিতা- মাতার শুকরিয়া আদায় করাকে ও বান্দার ওপর একত্রিত করে অপরিহার্য করেছেন। এখানে পিতা-মাতার বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে তাদেরকে ‘উহ’ বলবে না, এখানে ‘উহ’ শব্দটি বলতে বুঝানো হয়েছে যা দ্বারা বিরক্তি প্রকাশ পায়। হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম বলেন, পীড়া দানের ক্ষেত্রে ‘উহ’ বলার চাইতে কম কোন স্তর থাকলে তাও অবশ্যই উল্লেখ করা হত। পিতা-মাতার সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলা নিষেধ। তাদের সাথে সম্প্রীতি ও ভালবাসার সাথে নরম স্বরে কথা বলতে হবে। তাদের সামনে নিজেকে সবসময় অক্ষম ও হেয় করে পেশ করবে। পৃথিবীর এমন কোন ধর্ম নাই যাতে পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়ার কথা রয়েছে।
এতে প্রমাণিত হয় যে, বান্দার জন্য আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের পর পিতা মাতার আনুগত্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । এবং আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞ হওয়ার ন্যায় পিতা মাতার কৃতজ্ঞ হওয়া ওয়াজিব (তাফসিরে কুরতুবী)। অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে ঃ মানব জাতির দুনিয়ার বুকে অস্তিত্ব লাভের দুটি উপায় ও পথ সম্পর্কে উক্ত আয়াতে আল্লাহ পাক আলোচনা করেছেন। একটি কারণ হল, আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন। তাই মানবজাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। দ্বিতীয়টি হল বাহ্যিক কারণ । আর তা হল পিতা-মাতা।
আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের জন্য জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভধারণ করেছে। দুধ ছাড়াতে দুই বছর হয় নির্দেশ দিয়েছি সেই। আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই। তবে তুমি তাদের কথা মানবে! এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয় তার পথ অনুসরণ করবে। অতএব তোমাদের প্রত্যাবর্তণ আমারই দিকে (সূরা লোকমান: ১৪-১৫)।
অত্র আয়াতের বিবরণ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহ তা’আলার স্বীয় ইবাদতের পর পরই পিতা-মাতার হক সম্পর্কিত বিবরণের মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছেন যে, প্রকৃত পক্ষে সমস্ত নিয়ামত ও অনুগ্রহ একান্তই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে। কিন্তু বাহ্যিক উপকরণের দিক দিয়ে লক্ষ করলে দেখা যায়, আল্লাহ র পর মানুষের প্রতি সর্বাধিক ইহসান বা অনুগ্রহ থাকে পিতা-মাতার। সাধারণ উপকরণ সমূহের মাঝে মানুষের অস্তিত্বের পেছনে পিতা-মাতাই বাহ্যিক কারন। এ জন্যই কোরআন শরীফে পিতা-মাতার হক সমূহকে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে।
মুসনদে আহমদ, তিরমিজী ও ইবনে মাজাহ’র বিশুদ্ধ সনদসহ হযরত আবুদ্দারদা (রা:) থেকে বর্ণিত রয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, পিতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা। এখন তোমাদের ইচ্ছা এর হেফাজত কর অথবা একে বিনষ্ট করে দাও।
আসুন পিতা মাতার খেদমতে নিজেদের উজাড় করে দেই। তাঁদের সঙ্গে সদাচরণ করে তাঁদের অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকি তাহলেই সফল হবে আমাদের জীবন। সফল হবে আমাদের মরণ। লেকখ: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও আহ্বায়ক, আদর্শ কলম সৈনিক (আ.ক.স), কুমিল্লা।