আরাকানের কান্না
মুহাম্মদ কামাল হোসেন : মিয়ানমারে হাজারো মুসলমান নারী-শিশু ও ভাই-বোনেরা নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছে। পুঁড়ছে বসত ভিটা ও আবাদি জমির ফসল। আরাকানের মাটি রঞ্জিত হচ্ছে নিরীহ শহীদদের বুকের তাজা রক্তে। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই। মুসলমানদের খুন রাঙা লাশ পড়ে রয়েছে যত্রতত্র। অথচ আমরা এখনো বিভোর রয়েছি কুরবানির গোশত দিয়ে উদরপূর্তি রসনাবিলাস ও ভোগ তামাশা নিয়ে। বাজারের মোটা তাজা গরু কিনে এবার কোরবানি দিয়েছি বলে এখনো জনে জনে জানান দিচ্ছি। তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি। দাওয়াত-মেজবানি নিয়ে ছুঁটে বেড়াচ্ছি আত্ত্বীয়-স্বজনদের বাড়ি। আরেক দিকে সেলফি তুলছি। রঙ্গ তামাশা ও মৌজ মাস্তি করে এসব ছবি ফেসবুকে চালান করছি, একের পর এক শেয়ার করছি। লাইক-কমেন্টে বিভোর হচ্ছি। আর ভাবছি আমার মত সাচ্চা মুসলমান আর কয়জন আছে। একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে নিজেকে সর্বত্র গলাবাজি করে জানান দিচ্ছি। অথচ এদিকে আমাদেরই নাকের ত্রিসীমানায় আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা বিনা দোষে প্রাণ হারাচ্ছে। আজ বিশ্বময় মুসলমান বনি আদমের সন্তানেরা একের পর এক মার খেয়ে যাচ্ছে। খোদার দিকে রুজু হয়ে সাহায্য কামনা করছে। গগনবিদারী কান্না আর বুকফাটা আর্তনাদ করে বলছে, হে আল্লাহ আমাদের বাঁচাও। পাঠাও কোন সাহায্যকারী। বার্মার রোহিঙ্গা মুসলমানের কান্নায় পৃথিবীর আকাশ ভারী হয়ে উঠছে। মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুরা বাচাঁও বাচাঁও বলে আর্তচিৎকার করছে। মায়ানমারের বর্বর সরকার তাদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালাচ্ছে। হত্যা করছে অসংখ্য নিষ্পাপ শিশু, যুবক, বৃদ্ধাদেরকে। ধর্ষণ করে কলঙ্কিত করছে অসংখ্য মা-বোনদের। বিধবা করছে হাজারো নারীদের। সন্তানহারা করছে অসংখ্য মাকে। স্বামীহারা করছে অসংখ্য স্ত্রীকে। ভাইহারা করছে অসংখ্য বোনকে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের আহাজারীতে পৃথিবীর আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছে। বিশ্ব মুসলমানদের সহযোগীতা ও ভ্রাতৃত্বের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ও.আই.সি নিশ্চুপ। নিশ্চুপ জাতিসংঘ । কাগজে কলমে দুএকটা বিবৃতি দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না মায়ানমারের বর্বর সরকার । গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এভাবে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। নিজ দেশে থাকতে না পেরে তারা বাঁচার আশায় থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সমুদ্র পথে নৌযানে পাড়ি জমাচ্ছে। নৌযান ডুবে তারা সাগরের পানিতে ভাসছে ও ডুবে মরছে। সাগরে ভাসতে ভাসতে শুধু রোহিঙ্গা মুসলমান মরছে না, মানবতারও মৃত্যু হচ্ছে। তাদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসা সকলের মানবিক দায়িত্ব।
মুসলিম জনগণের ওপর সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, অমানবিক এবং অবৈধ, নৃশংস হত্যাকান্ডের মাধ্যমে মুসলমান শুন্য করার খেলায় মেতে উঠেছে মায়ানমার। নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এ নৃশংস বর্বরতার নিন্দা জানানোর ভাষা অভিধানে আজ পরাজিত! রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে গোটা বিশ্বের অমুসলিম শক্তি আজ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। মানবিক সংস্থাগুলো এখনও নিশ্চুপ! রোহিঙ্গা মুসলমানদের কীবা দোষ ছিল, যার কারণে তারা আজ নির্মম-জুলুম নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে? কারণ একটাই ওরা যে মুসলমান। ধর্মীয় পার্থক্য ও বৈপরিত্যের কারণেই রোহিঙ্গাদের উপর মায়ানমারের সামরিক জান্তা, প্রশাসন ও বৌদ্ধ এবং সা¤্রাজ্যবাদী গোষ্ঠিরা তাদের উপর সীমাহীন জুলুম চালাচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠি। শত শত বছর ধরে তারা নির্যাতিত ও নিপিড়ীত হচ্ছে। নির্যাতনের চিত্রগুলো বিশ্বমিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিভৎস চেহারাগুলো দেখে কার চোঁখ না অশ্রুসিক্ত হবে? চোখের সামনে ভাই-বোন, মা-বাপ, ছেলে-মেয়েদের যদি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে, শরীরের উপর কামান তুলে মাথার মগজ বের করে ফেলে, চোঁখের সামনে তাজাদেহ দ্বিখন্ডিত করে ফেলে তখন কেমন লাগবে? বার্মার মুসলমানদের সাথে তাই করা হচ্ছে! জাতিসঙ্ঘ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিশ্বের সবচেয়ে বর্বর নির্যাতনের শিকার জনগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করেছ
বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ওরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হযেছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে যে সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওযা একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা। তবে, ওখানকার রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ঐ রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানগণ বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাউকে তাড়িত করবে। এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল স¤্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে। ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিম বিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম হত্যা করে। শত শত বছর ধরে তারা মিয়ানমারে বাস করে এলেও মিয়ানমার সরকার তাদেরকে সেদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বলা হয় এরা বহিরাগত। ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায় এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্ব প্রথম গড়ে উঠা মুসলিম বসতি ওয়ালা প্রদেশের মধ্যে বর্তমানের আরাকান তথা রাখাইন প্রদেশ ছিল উল্লেখ যোগ্য। ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আরাকানের স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। ২০০ বছরের বেশি সময় সেটা ছিল স্থায়ী। ১৬৩১ থেকে ১৬৩৫ পর্যন্ত আরাকান রাজ্য এক কঠিন দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আর এই দূর্ভিক্ষই আরাকান থেকে মুসলিম প্রশাসকের পতন ঘটে। ১৯৮১ সালে মিয়ানমারের সামরিক শাসনকর্তা আরাকান রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন প্রদেশ করে, এটা বুঝানো উদ্দেশ্য যে, এ রাজ্য বৌদ্ধ রাখাইন সম্প্রদায়ের, রোহিঙ্গা মুসলমানদের নয়। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং সরকারিভাবে তাদেরকে সেখানে ‘বসবাসকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাদের ভোটাধিকার নেই। নেই কোন সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার। নিজ দেশে পরবাসী তারা। তারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যেখানে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যাগুরু আজ সেখানে তারা সংখ্যালঘু। বড় আফসোস! আজও রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার। বার্মা বা মিয়ানমার দেশটির রাখাইন রাজ্যে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করছে এবং তাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালি অভিবাসী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করে। তাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করছে মিয়ানমার সরকার। বর্তমানে লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু শিবিরে আটক অবস্থায় রয়েছে। মায়ানমারের সামরিক জান্তা তার অধিবাসী মুসলমানদের জন্য সে দেশকে জাহান্নামের অগ্নিকুন্ডে পরিণত করেছে। তাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে উপার্জিত সব সম্পদের মালিকানা, নাগরিক অধিকার, মানবিক অধিকার, এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারও। তাই তারা সমূহ বিপদের কথা জানার পরও মরিয়া হয়ে ছুটছে একটুখানি নিরাপদ ঠিকানার সন্ধানে। সর্বহারা এসব আদম সন্তন মৃত্যুর অপেক্ষায় বেঁচে আছে। আজ সময় এসেছে, মিয়ানমারের উগ্রবাদী বৌদ্ধদের চলমান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বময় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মুসলিম রোহিঙ্গাদের ন্যায্য অধিকার ও সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও কলামিস্ট