রহমত, বরকতের জুমার দিন
মোস্তফা কামাল গাজী
মানব সৃষ্টির শুরুলগ্ন থেকে জুমার দিনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে ঘটেছে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনাবলি। মহিমাময় ¯্রষ্টার মাহাত্ম্য, বড়ত্ব আর সুনিপুণ কার্যক্ষমতার প্রকাশ পেয়েছে এসব ঘটনার মাধ্যমে। হজরত আদম (আ.) এর সৃষ্টি ও তার দেহে রূহ ফুৎকার, জান্নাত-জাহান্নামের সৃষ্টি, কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার দিনক্ষণ ইত্যাদি তার অন্যতম। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে এ দিনটি অধিক প্রিয়। এদিনের মাহাত্ম্যের গভীরতা অনেক দীর্ঘ। এর সঙ্গে এদিনের ফজিলতও রয়েছে অনেক। জুমার দিনের ফজিলত এতো বেশি যে এদিনকে বলা হয় গরীবদের হজের দিন। সুতরাং জুমার দিনের সকল আহকাম পলন করে জুমা আদায় করলে হজের সওয়াব মিলে। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘হে ঈমানদারগন, যখন জুমার নামাজের দিকে ডাকা হবে, তখন সকল ক্রয়বিক্রয় ফেলে নামাজে ছুটে আসো। এটাই তোমাদের জন্য মঙ্গলকর।’ (সুরা জুমা : ৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জুমার দিন সকল দিনের সর্দার। এ দিনটি আল্লাহ তায়ালার নিকট ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা থেকেও অধিক মর্যাদাপূর্ণ। এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তা হলো, ১. হজরত আদম (আ.) কে আল্লাহ তায়ালা এ দিনে সৃষ্টি করেছেন, এদিনে তাকে জমিনে নামিয়েছেন, এদিনেই তাকে মৃত্যু দিয়েছেন এবং এদিন এমন একটি সময় রয়েছে, যাতে কোনো বান্দা হারাম জিনিস ব্যতীত যা কিছু আল্লাহর নিকট চাইবে, আল্লাহ তাই দিয়ে দিবেন।’ (ইবনে মাজাহ : ৭৬) হজরত ওমর (রা.) কে এক ইয়াহুদি বললো, ‘হে আমিরুল মু’মিনিন, কোরআনের এমন একটি আয়াত রয়েছে, যদি তা আমাদের ধর্মে নাজিল হতো, তাহলে সে দিনটিকে আমরা ঈদের দিন পালন করতাম। সে আয়াতটি হচ্ছে, ‘আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দীনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নি’মাতী’।’ হজরত ওমর (রা.) বললেন, সে আয়াতটি আরাফা ও জুমার দিন নাজিল হয়েছে।’ (বুখারি : ৬৭২৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং জুমার নামাজ মধ্যবর্তী সময়ের সকল গুনাহের কাফফারা, যতক্ষণ না সে গুনাহে কবিরায় লিপ্ত হয়। (বুখারি : ৩৪২)
অন্য হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, জুমআর দিন মসজিদের প্রত্যেকটি দরজায় ফেরেশতারা বসে জুমায় আগন্তুকের জন্যে সওয়াব লিখেন। যে আগে আসে তার সওয়াব লিখেন বেশি। যে পরে আসে তার জন্য লিখেন কম। যখন ইমাম খুতৎবার জন্য দাঁড়ান তখন ফেরেশতারা খাতা বন্ধ করে খুৎবা শুনতে বসে পড়েন। যে মসজিদে সর্বপ্রথম আসে তার জন্য ফেরেশতারা উট কুরবানি করার সওয়াব লিখেন, যে এরপর আসে তার জন্য একটি গরু কুরবানির সওয়াব লিখেন, যে এরপর আসে তার জন্য একটি ছাগল কুরবানি করার সওয়াব লিখেন, এরপর যে আসে তার জন্য একটি মুরগি সদকার সওয়াব লিখেন, যে এরপর আসে তার জন্য লিখেন একটি ডিম সদকা করার সওয়াব।’ (বোখারি : ১৪১৬)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সমস্ত দিন থেকে জুমার দিন উত্তম। এদিন হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এদিনেই তাকে জান্নাত থেকে জমিনে নামানো হয়েছে।’ (মুসলিম : ২৮২) জুমার দিনের ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘আমরা সর্বশেষ উম্মত, আমরা সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবো। যদিও আমাদেরে পূর্বে অন্য উম্মতদের কিতাব দেয়া হেয়েছে এবং আমাদের দেয়া হয়েছে পরে। ইবাদতের জন্য জুমার দিনকে গ্রহণ করতে ইয়াহুদি ও নাসারাদের ইচ্ছাধীন দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ইয়াহুদিরা শনিবার ও নাসারারা রবিবারকে গ্রহণ করে। অবশেষে এদিনের ফজিলত আমাদের ভাগ্যে আসে।’ (মুসলিম : ২৮২)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জুমার দিন গোসল করে যে ব্যক্তি মসজিদে যাবে, সুন্নত আদায় করবে, চুপচাপ খুৎবা শুনবে এবং ইমামের সঙ্গে নামাজ আদায় করবে তার এ জুমা থেকে নিয়ে সামনের জুমা পর্যন্ত সকল (সগিরা) গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (মুসলিম : ২৮৩) দোয়া কবুলের সময়: জুমার দিন এমন একটি সময় রয়েছে যখন বান্দা যে দোয়া করবে সে দোয়াই কবুল হবে। এ প্রসঙ্গে নবি করিম (সা.) বলেন, ‘জুমার দিন এমন একটি সময় রয়েছে যাতে নামাজের পর বান্দা আল্লাহর নিকট যা চাইবে, আল্লাহ তাই কবুল করবেন।’ (মুসলিম : ২৮১) দোয়া কবুলের সময় কোনটি, তা কোথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। হতে পারে এতে মহান আল্লাহ তায়ালার অনন্য হেকমত নিহিত রয়েছে, যেনো জুমার পুরো দিন বান্দা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে। তবুও দোয়া কবুলের সময় সম্পর্কে আলেমগণ কয়েকটি মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেন, এ সময়টি হলো ফজরের পর; কেউ বলেন, দ্বিপ্রহরের সময়; কেউ বলেন, খুৎবার সময়; কেউ বলেন, আসর থেকে মাগরিবের আগ পর্যন্ত এর মধ্যবর্তী সময়। (তোহফাতুল মুনইম : ৩/৩৪৬) সময় নিয়ে মতভেদ থাকলেও নির্দিষ্ট সে সময়টিতে দোয়া কবুলের ব্যাপারে কারো মতভেদ নেই। তাই সবার উচিত, পুরো দিনটি ইবাদত করে কাটানো।
জুমার দিনের কয়েকটি সুন্নত
মেসওয়াক করা, গোসল করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, উত্তম কাপড় পরিধান করা, হাত-পায়ের নখ কাটা, পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া। এ প্রসঙ্গে নবি করিম (সা.) বলেন, ‘যে জুমার নামাজে আসবে, সে যেনো গোসল করে আসে।’ (মুসলিম : ২৮০) অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘জুমার দিন সবার উচিৎ মেসওয়াক করে গোসল করা এবং সুগন্ধি লাগিয়ে মসজিদে আসা, যদি সুগন্ধি না থাকে তাহলে স্ত্রীর সুগন্ধি হলেও গায়ে মেখে আসা উচিৎ।’ (মুসলিম : ২৮০) উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদিস দ্বারা জুমার দিনের মাহাত্ম্য, ফজিলত ও এদিনের সুন্নতসমূহ জানা গেলো। প্রত্যেক মুমিমের উচিৎ জুমার দিনকে গুরুত্ব দিয়ে সকল ব্যস্ততাকে পেছন ফেলে ইবাদতে মশগুল থাকা।