অং সান সুচি : বিশ্বধিকৃত এক নোবেলজয়ী!
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে : মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির জন্য এই শিরোনামটি কতোটা যথোপযুক্ত তা বিশ্ববাসীর কাছে আজ দিবালোকের মতো উন্মোচিত। দক্ষিণ আফ্রিকার ডেসমন্ড টুটো, তিব্বতের দালাইলামা ও বাংলাদেশের ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়াও নোবেলপ্রাপ্তদের মাঝে সবচেয়ে নবীন ও কানাডার সম্মানিত নাগরিক মালালা ইউসুফজাই পর্যন্ত বলতে দ্বিধা করেননি যে, সুচি রোহিঙ্গাদের রক্ষায় তার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ভূলুন্ঠিত করেছেন। একই ভাষ্য দিয়েছেন কানাডার সাবেক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো এন্ড্রু বেনেট। পাশাপাশি অনলাইন চেঞ্জ ডটঅর্গে কানাডার ক্যুইবেক প্রদেশের গেঁতেন্যূ থেকে জনৈক ফরিদ খান সুচির ‘ভুয়া তথ্য’কে কেন্দ্র করে তার সন্মানিত নাগরিকত্বটি বাতিল চেয়ে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বরাবরে আবেদন জানিয়েছেন। তাতে এক সপ্তাহেরও কম সময়ে ২৫ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রায় এ পর্যন্ত ২০ হাজার ৭২৮ জন স্বাক্ষর করেছেন। এতে আগামী শনিবার ১৬ সেপ্টেম্বর টরন্টো স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত অন্টারিও প্রাদেশিক পার্লামেন্টের কুইন্স পার্কে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
ফলে গতকাল নিরুপায় প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো সুচিকে ফোন করতে বাধ্য হন। সে তথ্য প্রধানমন্ত্রীর ওয়েবসাইটসহ টুইটারে প্রকাশ পেয়েছে। তাতে প্রকাশ, সুচিকে ‘নৈতিক ও রাজনৈতিক নেত্রী’ আখ্যায়িত করে রাখাইন রাজ্যে মুসলিমসহ সংখ্যালঘুদের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে চলমান সহিংসতা নিরসনসহ নাগরিকদের সুরক্ষায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর জন্য প্রবেশাধিকার উন্মুক্তের বিষয়ে জোর দাবি জানানো হয়। পরস্পর তারা ফোনে সকল সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষার বিষয়টি আলোচনা করেন। একই সঙ্গে সকল জাতিসত্তার সম্মানজনক অধিকার রক্ষায় এবং শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল মিয়ানমার গড়ায় কানাডার সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। সুচি কানাডার মানবিক সাহায্যের ভুয়সী প্রশংসা করেন। সংক্ষেপে এই তথ্যটি ট্রুডোর ওয়েবসাইটে রয়েছে। আর টুইটার বার্তায় রয়েছে- ‘টুডে আই স্পোক উইথ অং সান সুকি টু কনভে কানাডাজ ডিপ কনসার্নস ফর রোহিঙ্গা মুসলিমস ইন মিয়ানমার’।
প্রশ্ন জাগে, অং সান সুচিকে এই জ্ঞানদান কতখানি যথার্থ? কেননা ২০১২ সালে সুচি শান্তিতে নোবেল গ্রহণকালে যুদ্ধবিগ্রহে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমব্যাথী হয়ে বিশ্ববাসীকে আবেগ তাড়িত ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের ক্ষুধা, জরা, বসতি উচ্ছেদ, বেকারত্ব, দরিদ্রক্লিষ্টতা, বৈষম্য, অধিকারহীনতা ও অন্ধত্বপূর্ণ মোহের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে’। আরও বলেছেন, ‘যেখানে ক্লেশক্লিষ্টতা উপেক্ষিত, সেখানেই সংঘাতের বীজ রোপিত; কেননা ক্লেশক্লিষ্ট যন্ত্রণা হীনমন্য করে তোলে, তাতে অন্তর্দাহ ও সংঘাত ফুঁসে ওঠে’। ভাবা যায়, সেই ভাষণ পাঁচ বছর না গড়াতেই আজ পুরোপুরি তিরোহিত ও উধাও!
মাত্র গত তিন সপ্তাহে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ১৭৮টি ভস্মীভূত গ্রাম থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজারেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ৪ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর পর্যায়ে আশ্রয় নিয়েছে। ৪ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, যা গণহত্যা হিসেবেই দৃশ্যমান। বিশ্ব সেটা দেখেছে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও নিশ্চুপ থাকেনি। স্বয়ং কবি নির্মলেন্দু গুণ ফেসবুক স্টাটাসে লিখেছেন, ‘মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই’। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার পক্ষে মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঔদ্ধত্য এবং তার বর্বর সেনাদের এই অবিশ্বাস্য অমানবিক আচরণ মেনে নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমি ঘুমাতে পারছি না। আমি মনে করি, বাংলাদেশের পক্ষে বার্মা সরকারের যথেচ্ছাচারের নীরব দর্শক হয়ে সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকার সুযোগ নেই। শয়তানদের সমুচিত জবাব দেবার জন্য এখন আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করার সময় এসেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও শান্তির জন্য নোবেলজয়ী অশান্তি বেগমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কথা এখনই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হোক। অনেক হয়েছে, আর নয়। আমি ভগ্নবক্ষ নিয়েও সেই ন্যায়যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে রাজী আছি। আমি বিশ্বাস করি, যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিবেক আমাদের পাশে থাকবে এবং ১৯৭১ এর মতো বার্মার বর্গীদের বর্বরতার বিরুদ্ধে আমরাই জয়ী হবো’।
ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিশ্চুপ থাকেননি; উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়েছেন এবং জাতীয় সংসদে সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে বলে জানিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘মিয়ানমার থেকে আসা সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। ওই দেশে নিরাপদ অঞ্চল গঠন করে তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। কারণ, রোহিঙ্গা সংকটের সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। তাদেরই এর সমাধান করতে হবে। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে’। কিন্তু এই কথাগুলো কী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি ফোনে অং সান সুচিকে জানাতে পারতেন না, যেমনটা জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো? রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে মালদ্বীপ যদি মিয়ানমারের সঙ্গে সকল প্রকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে, সেখানে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারে চাল আনতে যাওয়া কতটুকু মানবিকতা, কার্যকর কূটনীতি ও দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের নেতৃত্বগুণের পরিচায়ক ?
এক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক ও এশিয়ান হাইওয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কারণে আমাদের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী চীন ও ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে মিয়ানমারের ওই অমানবিক আচরণে নিশ্চুপ রয়েছে, কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় নিশ্চুপ নেই। ব্রিটেন ও সুইডেনের প্রস্তাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতা প্রদর্শন করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্থোনিও গুয়েতরেজ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রোহিঙ্গা সমস্যাকে ‘বিপর্যয়পূর্ণ’ আখ্যা দিয়েছেন এবং কয়েক দশকের চলমান এ সমস্যার প্রার্দুভাব যে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে তারই আভাস মেলে ধরেছেন। এতে শেষটায় অং সান সুচিও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান বাতিল করেছেন এবং আগামী মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিশদ আলোকপাত করবেন বলে আগাম জানিয়েছেন। এখন দেখার পালা বিশ্বধিক্কার থেকে রক্ষা পেতে এক কালের গণতন্ত্রকামী ও শান্তিতে নোবেলজয়ী সুচি সেখানে কী বলেন? সকলের চোখ-কান খুলে তা জানা ও বোঝা দরকার, অন্ততঃ বাংলাদেশের জন্য তা জরুরী।
ই-মেইল: [email protected]