ত্রাণের ব্যাপারে অ্যাসেসমেন্ট এবং বড় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার
রাজেকুজ্জামান রতন
মানুষ অভাবে থাকলেও তার চেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে তার পারিপার্শ্বিক চাপ। আজকেও মশিউল আলমের একটা দারুণ লেখায় এসেছে যে, যারা বলেছিল ত্রাণ পায়নি, তাদেরকে এমনভাবে ধমক দেওয়া হয়েছে যে, তুমি ত্রাণ পেয়েছ কি পাওনি সেটা বলার কী দরকার? ফলে মানুষ ত্রাণ না পেয়ে আবার প্রাণ হারাতে চায় না। সে কারণে অনেকে ত্রাণ না পেলেও চুপ করে থাকে। মনে করছে, এই কষ্ট-দুঃখ এটা তার কপালের। ত্রাণের পরিমাণ এবং ত্রাণ প্রার্থী মানুষের সংখ্যার মধ্যে একটা বিশাল ব্যবধান রয়েছে।
দেখলাম যে, নওগাঁতে বন্যার্ত মানুষের সংখ্যা হচ্ছে দুই লাখ, সেখানে নগদ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে পাঁচ লাখ। তাহলে ত্রাণটা কিভাবে দিবে? একটু যদি আমরা খেয়াল করে দেখি, কি পরিমাণ বন্যা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং কি পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, তাহলে বোঝা যাবে এই ত্রাণ আসলে দেওয়ার মতন নয়। ফলে খুবই নির্বাচিত যে জায়গাটায় হয়তো একটু নজরটা বেশি পড়ে। যে সমস্ত এলাকায় সাংবাদিকরা যান সেই সমস্ত এলাকা অথবা হাতের কাছে যারা আছেন কিংবা যারা মানুষের চাইতে ভোটার হিসেবে বেশি বিবেচিত। মানুষের ত্রাণ দেওয়ার চাইতে ভোটারদের মন জয় করার প্রবণতাটা অনেক বেশি দেখা যায়। যেকোনো দুর্যোগ আমাদের ক্ষমতাসীনদের জন্য একটা সুযোগ এনে দেয়, সেটা কখনো কখনো তাদের অভাবকে কেন্দ্র করে তাদের কাছে পরিত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হওয়া অথবা কখনো ভবিষ্যতের ভোটের কথা বিবেচনায় রেখে তাদের ভোটটা নেওয়া।
যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী যায়, সেখান থেকেও লুটপাট করা হয়। ফলে একদিকে ত্রাণ দিয়ে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করা আর অন্যদিকে ত্রাণ না দিয়ে লুটপাটের টাকাটা আত্মসাৎ করা দুটিই চলতে থাকে। ফলে আমরা মনে করি যে, এটার একটা সামগ্রিক মনিটরিং হওয়া দরকার কিন্তু আমরা সরকারের কাছ থেকে প্রথম শুনলাম যে, না না বন্যা তেমন হয়নি! তারপরে আবার দেখলাম প্রধানমন্ত্রীও যাচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ দিতে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন তারা ত্রাণ সংগ্রহ করতে গেলে দেখা যায় পুলিশ বাধা দিচ্ছে, ছাত্রলীগ বাধা দিয়ে বলছে যে, আপনারা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। একদিকে দেখা যাচ্ছে যে, ত্রাণ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী চলে আসছেন বগুড়ায়, চলে যাচ্ছেন গাইবান্ধায়। ফলে এই যে একটা পরস্পরবিরোধী অবস্থান, এটাও মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে।
মানুষের একটা সমস্যা হলে, সমস্যাটা লুকিয়ে রাখলে তো সমস্যাটির সমাধান হবে না! বরং সমস্যাটাকে কত ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারি তার ব্যবস্থাটা নেওয়া দরকার। এখন সমস্যা মোকাবিলার চেয়ে বিরোধিতা মোকাবিলার দায়িত্বটা বড় বেশি হয়ে পড়েছে। সে কারণে ত্রাণ প্রাপ্য এবং ত্রাণ প্রাপ্ত মানুষের ব্যবধানটা দিনে দিনে বাড়ছে।
সরকারের একটা ডিজেস্টার অ্যাসেসমেন্ট করা দরকার। কি পরিমাণ দুর্যোগ হয়েছে তার অ্যাসেসমেন্টটা দরকার, কি পরিমাণ মানুষের খাদ্য দেওয়া দরকার এবং কি পরিমাণ মানুষের পুনর্বাসন করা দরকার। কারা কৃষিঋণ নিয়ে বির্পযস্ত আছে, সেই কৃষি ঋণটা কিভাবে মওকুফ করা যায় অথবা তাদেরকে আবার সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া যায়, যারা এনজিওতে ঋণের জালে জড়িত হয়ে আছে তাদেরকে সেখান থেকে মুক্ত করা যায় কিভাবে? এখন একটা ব্যাপক মানুষের অভিবাসন ঘটবে গ্রাম এবং দুর্গত অঞ্চল থেকে শহর অঞ্চলে।
ফলে এই যে আশ্রয়হীন, কর্মহীন, খাদ্যহীন এবং ভবিষ্যতহীন মানুষদেরকে কিভাবে কাজে পুনর্বাসন করা যায়, সে পদক্ষেপটা নেওয়া দরকার। শুধুমাত্র ২ কেজি চাল, ১ কেজি আটা, ৫০০ গ্রাম ডাল দিলেই তার সমস্যাটা মিটবে না। এটা তো একদিনের সমস্যা না, বহুদিনের সমস্যা। সুতরাং তার যে ফসলটা নষ্ট হয়ে গেল তাকে তো সারভাইব করতে হবে। এক বছরের জন্য একটা সামগ্রিক ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট থাকা দরকার কিন্তু আমাদের এখানে নেই সবই হচ্ছে আপদকালীন এবং কখনো কখনো অ্যাডহক ভিত্তিতে। যেখানে বন্যা আসছে বন্যার ওপর ভিত্তি করে কিছু ত্রাণ, বন্যার বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। বাঁধ মেরামতের নামে আবার সেখানে কিছু দুর্নীতি, বন্যা আসছে, কিছুদূর পর পর ভাঙন ঠেকানোর জন্য সেখানে কিছু কাজ এবং দুর্নীতি এটা একটা চক্রাকারে চলছে। আমরা মনে করি, এর একটা বিরাট অ্যাসেসমেন্ট হওয়া দরকার এবং এব্যাপারে একটা বড় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
পরিচিতি: কলামিস্ট ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাসদ
মতামত গ্রহণ: মাকসুদা আখতার
সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ