৮৪ বছরের মুক্তিযোদ্ধা সুন্দর আলী শেখ, রিকশা চালান ৩৬ বছর ধরে
রিকু আমির : দেশ পাক হানাদারমুক্ত শেষে ৪৪ বছরের ‘ঢাকা বাসিন্দা’ জীবনে গোপালগঞ্জ কোটালিপাড়ার সন্তান ৮৪ বছর বয়স মো. সুন্দর আলী শেখ রিকশা চালিয়ে জীবন-যাপনের আর্থিক যোগান দিচ্ছেন ৩৬ বছর ধরে। স্ত্রী হারা, উপার্জনক্ষম সন্তান ও গ্রামে ভিটেমাটিহারা সুন্দর আলী ভাড়ায় চালিত রিকশা চালাতে বাধ্য হচ্ছেন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া সত্বেও। গতকাল শুক্রবার সকালে রায়ের বাজারের জীর্ণশীর্ণ বাসা থেকে পান্তাভাত-লবণ খেয়ে বেরিয়ে আসা সুন্দর আলীর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের প্রথম সাক্ষাৎ হয় গত সপ্তাহে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। শুক্রবার দুপুরেও তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। তার রিকশার সম্মুখে টিনের খ-িত অংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি অঙ্কন করা। এর পাশে তার একটি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি লাগানো। এটি নষ্ট হয়ে গেছে।
সুন্দর আলী কোটালিপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের মৃত ওফাজ উদ্দিন শেখ ও মাজু বিবি দম্পত্তির তৃতীয় সন্তান। ৫ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছাড়া সবাই মারা গেছে। বড় ভাই জোবেদ আলী শেখ ও মেজো ভাই নজর আলী শেখের মৃত্যু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়, পাকসেনাদের গুলিতে বলে সুন্দর আলীর ভাষ্য।
তিনি জানান, প্রথমদিকে তিনি নিজ গ্রামে বিভিন্ন বাড়ির উঠানে পাকা সবরি কলা, কচি ডাব ঝুলিয়ে রাখতেন নাগালের মধ্যে। এসবে তিনি ইনজেকশন সিরিঞ্জের মাধ্যমে বিষ মিশিয়ে দিতেন। এসব পাকহানাদাররা খেয়ে মারা পড়তো। এর কিছুদিনের মধ্যে তিনি তারই গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েতের দলে যোগদান করে বাড়ির খুব কাছেই বরিশালের রামশীল, কোদালধোয়ায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন বাবুর্চি বেশে। এর প্রায় ৫ মাসের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হয়। ঢাকায় আসার ১০ বছর পর জানতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের তালিকা হয়েছে। কিন্তু গ্রাম থেকে প্রস্তুত করা তালিকায় তার নাম ছিল না। এক্ষেত্রে তিনি কারও সহযোগিতা পাননি।
হৃদরোগের ছোবলে ৩৬ বছরের জীবন সঙ্গিনী মরিয়মের মৃত্যু হয় প্রায় ২ বছর আগে। তাদের ৩ সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান ফজলুল হক শেখ (৪৭) একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গুজীবন যাপন করছেন ৭ বছর ধরে। দুই মেয়ে নূরজাহান (৪২) ও রহিমুনের (৩৬) বিয়ে হয়েছে বরিশালে। পৈত্রিক সূত্রে গ্রামে ২ শতক জমির সাবেক মালিক সুন্দর আলী জানান, খাজনা না দিতে পারায় সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে সেই জমি।
একটি প্রশ্নের উত্তরে সুন্দর আলী জানান, তার দলের সদস্য ও তার গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা হাসেন সরনামার কাছে গেলেই সত্যতা মিলবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুন্দর আলীর পরিচয়।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে দেড় থেকে দুইশত টাকা আয় করেন সুন্দর আলী। এ থেকেই খাওয়া-দাওয়া এবং রিকশার ভাড়া দিন প্রতি ৭০ টাকা দিতে হচ্ছে।
সুন্দর আলী বলেন, এমনে রিকশা ভাড়া ১২০ টেকা, কিন্তু রিকশার মালিক ঈমান আলী আমার কাছ থেইকা নেয় ৭০ টেকা। ৩৬ বছরের রিকশা চালক জীবনে ঈমান আলীর গ্যারেজ তার দ্বিতীয় রিকশা গ্যারেজ বলে জানান সুন্দর আলী।
দৃষ্টি শক্তিতে সমস্যাগ্রস্থ সুন্দর আলী বেশকিছুদিন আগে চোখের ডাক্তার দেখিয়ে ছিলেন, কিন্তু আর্থিক অসামর্থ্যরে কারণে ১২০০ টাকা মূল্যের চশমা ব্যবহার করতে পারেননি। তিনি রায়ের বাজার থাকেন, সেখানের মালিক ঘর তার ভাড়া নেন না। প্রতিদিন সকালে পান্তাভাত খেয়ে বের হয় বাসা থেকে। দুপুরে ও রাতে বাইরে থেকে কিনে খায় কখনো বা কারও আর্থিক সহযোগিতায় খাদ্য জোটে তার ভাগ্যে। দুপুর ১টা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে বাসায় চলে যান, নাওয়া-খাওয়া-নামাজ ও বিশ্রামের উদ্দেশে।
কান্নারত অবস্থাতেই তিনি বলেন, বহুত চেষ্টা করছি শেখের বেটির লগে দেখা করণের (বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা)। সারাদিন তো ধানমন্ডিতেই থাকি। উনি যখন ৩২ এ আসে, তখন ঢোকার চেষ্টা করছি, পারি নাই। একটা বার যদি উনার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম…. তার চাওয়া একটিই- আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে জীবনযাপন করা। সম্পাদনা : গিয়াস উদ্দিন আহমেদ