মাদক নিয়ন্ত্রণে সামাজিক অঙ্গীকার ও আন্দোলন
ড. ফোরকান উদ্দিন আহমদ
মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ সমাজে সুস্থ সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন কামনা করে। সুস্থ জীবন সুনাগরিক হওয়ার অন্যতম অবলম্বন। সুনাগরিক হতে হয়ে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে সুস্থ জীবনের অধিকারী হতে হবে। শারীরিক ও মানসিক উভয় দিয়ে সুস্থ হলেই একজন নাগরিক রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে পারে। কাজেই সুস্থ জীবন সুনাগরিক হওয়ার চাবিকাঠি স্বরূপ। মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন হতে মাদকের উৎপত্তি হলেও বর্তমানে এর অনিয়ন্ত্রিত এবং ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে সমাজ ব্যবস্থায় এক মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। মাদকের করাল গ্রাসে মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস হচ্ছে। বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। এ সমস্যা প্রতিরোধে প্রয়োজন সামজিক গণসচেতনাতা। সমাজের সকল গুণী লোককে মাদক বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে বিশেষত সকল তরুন ছাত্র-ছাত্রী ও যুবকর্মীদের মাধ্যমে একে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিয়ে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে কার্যকর ভূমিকার প্রতি যতœশীল হতে হবে।
মাদকাসক্তি এক নীরব ঘাতক ব্যাধি। যে দ্রব্য গ্রহণে আসক্তি জন্মে তার নাম মাদকদ্রব্য। মাদকদ্রব্য গ্রহণ একটি বদঅভ্যাস, একটি আচরণগত সমস্যা, মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে মাদকাসক্তের স্বাস্থ্য হানি হয় জীবনীশক্তি কমতে থাকে, শরীরের ইন্দ্রিয়গুলি নিস্তেজ হয়ে যায়, আচরণগত সমস্য দেখা দেয়, মানসিক ভারসাম্য লোপ পায়, কর্মদক্ষতা ও ক্ষমতা গ্রাস পায়, হতাশা এবং অবসাদ তাকে ঠেলে দেয় এব অন্ধকার জীবনে। সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলে। কোনো ব্যক্তি মাদকাসক্ত হলে তার মধ্যে নানান রকম পরিবর্তন দেখা দেয়। এসব পরিবর্তনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন দৈহিক পরিবর্তন, আচরণগত পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন, বোধশক্তিতে পরিবর্তন, কাজেকর্মে পরিবর্তন ইত্যাদি। মাদকসক্তি অপরাধ নয়, রোগ। মাদকাসক্ত ব্যক্তি তাই কোনো অপরাধ নয়, একজন রোগী। মাদকাসক্তি একটি মারাত্মক বয়সের অসুস্থতা। এইডস, ক্যান্সার ও হৃদরোগের মত এটি একটি ভয়াবহ রোগ। এ রোগটি নিরাময়ের অযোগ্য হলেও মাদকাসক্ত ব্যক্তি যদি সুস্থতার জন্য আগ্রহী হন চিকিৎসা ও ও চিকিৎসা পরবর্তী পরিচর্যার মাধ্যমে অসুস্থ মনোভাব ও জীবন ধারা পরিবর্তন করেন, জীবনকে সুশৃঙ্খলপূর্ণ ভাবে পরিচালনা করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন তাহলে তিনি ও মাদকমুক্ত থেকে সুন্দর জীবন উপভোগ করতে পারেন।
মাদকাসক্তির অভিশাপে নিমজ্জিত এখন গোটা পৃথিবী। মাদকদ্রব্যের অয়াবহতা আজ কোনো দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধা নেই। সমগ্র বিশ্ব এ সমস্যার সম্মুখীন। পৃথিবীর অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এই সমস্যায় জর্জরিত। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জাতি আজ বেশি উদ্বিগ্ন কারণ বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে ধারণা করা হয় যে, বাংলাদেশে মাদকাসক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের প্রায় দ্বিগুন। এদেশের মাদকাসক্তদের অধিকাংশই তরুণ এবং শতকরা ৮৫ ভাগ মাদকাসক্তের বয়স ১৫ থেকে ১৯ বৎসরের মধ্যে।
মাদকাসক্তি কারণ বহুবিধ। উঠতি বয়সীর তরুণরা নেশা করে কৌতুহল বশত, বন্ধদের প্ররচনায় অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে উঠে, বাবা-মার অসুখী দাম্পত্য জীবনের কারণে অনেক হতাশাগ্রস্থা তরুণ নেশা করে থাকে, পাড়া মহল্লার ক্লারের আড্ডা থেকেও মাদকাসক্তির বিস্তৃতি ঘটে, কর্ম বিমুখতা ও ভ্রান্ত জীবনদর্শন, অপসংস্কৃতি ও অসৎ সঙ্গের প্রভাব, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা, ব্যক্তিত্ব ও নৈতিক দৃঢ়তার অভাব, মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, হতাশা (প্রধানত বেকারত্ব জনিত), অত্যাধুনিক সাজগোজের প্রবণতা ও স্মার্ট হওয়া সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লাভের অদম্য আকাঙ্খা ইত্যাদি মাদকাসক্তির কারণ।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি কিশোর অথবা যুবক। কিশোরের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা থেকে তা বিকাশের পথ প্রথমেই তিরোহিত হয়ে যায়। ছাত্র হলে সে তার লোপড়া করতে সক্ষম হয় না। অন্য পেশাদার হলে তাতেও মনোনিবেশ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। ফলে সারাজীবন সে বেকার ও বোঝা হয়ে যায়। আসক্ত ব্যক্তির মানসিক শারীরিক, সামাজিক ও পারিবারিক এবং আর্থিক অবনতি ঘটে থাকে।
মাদকাসক্তি প্রতিকার ব্যবস্থাকে সামাজিক আন্দোলন হিসাবে উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, আত্মকর্মসংস্থান ও মাদকবিরোধী বিভিন্ন র্যালী/সমাবেশের আয়োজন করতে হবে। এছাড়া মাদক সমস্যার সমাধান কল্পে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারের জন্য বর্তমান সরকারকে কিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এই প্রসঙ্গে কারিগরী প্রশিক্ষণের উপরও জোর দিতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসারের জন্য মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামগণ ও ধর্মীয় শিক্ষকগণ পারিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ বিষয়ও বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। এই লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের জীবনের প্রতি আস্থা বাড়াবার প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের জন্য বিভিন্ন পরামর্শ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধান করতে হবে।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচীর পাশাপাশি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনেরও পালন করতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কোনো অবস্থাতেই জাতিকরকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া যায়না। তরুণ প্রজন্মকে মাদকদ্রব্যের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরী। আর এই জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমগুলোর অত্যন্ত স্পষ্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গহণের প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া মাদকদ্রব্য চোরাচালানীদের বিরুদ্ধেও গণসচেতনাতা গড়ে তুলতে হবে।
আজকের ও আগামী দিনের সুস্থ, সুন্দর, সুখকর জীবনের জন্যই মাকদ্রব্যের ব্যবহার রোধ করতে হবে। সমগ্র বিশ্ববাসীকে মাদকবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার করার মধ্য দিয়ে মাদকের মরণ ছোবল থেকে বাঁচতে হবে। দেশ ও বিশ্ববিবেক সে প্রত্যাশাতেই প্রহর গুনছে। কবি সুকান্তের মত আমাদের সকলের দৃঢ় প্রত্যয় হোক-
‘চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ’
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার’
লেখক: উপ-মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি একাডেমি (পিআরএল)
সফিপুর, গাজীপুর/সম্পাদনা: আশিক রহমান