রোহিঙ্গা সংকট : যেভাবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ
অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ফোরামে নিশ্চয়ই তিনি রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরবেন। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় হবে। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিষয়টি আলোচনার সুযোগ আসবে। আমরা জানি, জাতিসংঘের এই বৈঠকটি হচ্ছে বিশ্ব কূটনীতির সর্বোচ্চ পর্যায়। কারণ, একসঙ্গে ১৯৩টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, সরকার প্রধান থাকবেন এবং তাদের সামনে রোহিঙ্গাদের সমস্যাটি তুলে ধরা যাবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় ধরনের মানবতার পরিচয় দিয়েছে। বিশাল একটি দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। সেই খবরটিও বিশ্বের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছানোটা জরুরি। একদিকে বাংলাদেশে চার লাখ রোহিঙ্গা এসেছে বা নতুন করে যে আসছে, এই সংখ্যা পাঁচ-ছয় লাখ ছাড়িয়ে যাবে। একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের ওপরে এটি একটি বড় ধরনের চাপ। এ বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের পাশে পাওয়া একটি বড় ব্যাপার। রোহিঙ্গাদের পাশে থাকবে বিশ্ব। এই সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্পদায়ের অংশ বলব, যেহেতু প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অনেক সাফার করছে। জাতিসংঘের ওই অধিবেশন উপলক্ষে অনেক গুলো দ্বি-পাক্ষিক, ত্রি-পাক্ষিক ও বহু পাক্ষিক বৈঠক হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে ভাষণ দেবেন। এছাড়াও বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য রাখবেন। আশা করছি, সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিশেষ করে যে দেশগুলো আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, এই ইস্যুতে যারা বিশেষ ভূমিকা রাখছেন যেমন: ভারত এবং চীন, এই দুটি রাষ্ট্রের সাথে কথা বলে বাংলাদেশের অবস্থানটা আরও দৃঢ় করতে হবে।
রোহিঙ্গাদের পুনঃর্বাসন, তাদেরকে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া, তাদের অধিকারের ব্যাপারে এই দায়বদ্ধতা সব রাষ্ট্রেরই আছে । কফি আনান এবং মিয়ানমার সরকার যৌথভাবে রির্পোটটা করেছে। পর্যবেক্ষন এবং সুপারিশ এসব বাস্তবায়ন করতে মিয়ানমার বাধ্য। বাস্তবায়ন করতে মিয়ানমার সরকারকে যে সব কমিটমেন্ট দিতে হবে সেগুলোও বিবেচ্য বিষয়। এই যে নয়-দশ লাখ শরণার্থী, তাদের কি ধরনের সহায়তার প্রয়োজন? তাদের পাশে দাঁড়ানো বা এদের জন্য বাংলাদেশের প্ল্যান কী? এখন দু’ভাবে রোহিঙ্গাদের সর্মথন দিতে হবে। বাংলাদেশে যারা এসে পৌঁছেছে, তাদের সহায়তা করতে হবে, যাতে তারা নিরাপদে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে। আর যারা এখনো আসেনি, তাদেরকেও নিরাপত্তা দিতে হবে। এ বিষয়গুলো উঠে আসবে প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে। এর চেয়ে ভালো ফোরাম আর হতে পারে না। চলমান সংকটের মধ্যেই যেহেতু জাতিসংঘের এই সাধারণ পরিষদের বৈঠকটা হচ্ছে, এই বৈঠকে ১৯৩টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত থাকবেন। তারা জাতিসংঘে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নিরাপত্তা বিষয়ক আলাপ-আলোচনা করবে। এখানে বিশ্ব জনমতটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অনেক দেশ আছে, যারা এই নিধনযজ্ঞ নিয়ে ভাবে না। এই ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য হয়তো বাংলাদেশের পক্ষে বিচার চাওয়াটা কঠিন হবে। কারণ, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য, মিয়ানমারও সদস্য। কিন্তু বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থা সেই বিচার চাইতে পারে। সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এই বিষয়গুলো আসবে। সেখানে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এখানে এথনিক ক্লিনজিং হচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এ বিষয়গুলো আলোচনায় আসবে ও সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাশ করা হবে।
এখন আমাদের বেশি দরকার নেতিক চাপ তৈরি করা। অনেকটাই তৈরি হয়েছে। এটাকে আরও দৃঢ় করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার থেকে কিছু প্রস্তাব আছে। এই প্রস্তাবগুলো মিয়ানমারকে একসেপ্ট করতে হবে। মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলো যদি একমত হন তাহলে এ কাজগুলো হবে। এ সমস্যাগুলো সমাধান হবে। এখন তাদের একমত করানো গুরুত্বপূর্ণ কুটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যাটা সমাধান না করার কারণে এটি জটিল আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে পাওয়ার পলিটিক্স, জাতীয় স্বার্থ এই বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা হয়তো রোহিঙ্গাদের মানবিক দিকগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কিন্তু যখন আন্তঃরাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক চাপ পড়ে বিভিন্ন ইস্যু আলোচনা হয়, তখন ওই সব দেশে নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ এবং তাদের শক্তির বিষয়টাকেই প্রাধান্য দেয়। এসব বিবেচনায় রাখতে হবে। একটা পর্যায়ে আমরা সফল হবো। আমরা রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াব। আমাদের সমস্যা হচ্ছে শরণার্থী। এটা কিভাবে ম্যানেজ করা যায়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটা জাতিগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের বিষয়টা মানবিক সংকট। বাংলাদেশ সেটা অনুভব করে এবং যে কোনো দেশের সেটা অনুভব করা উচিত। আমরা বাংলাদেশের স্বার্থটাই দেখব। মিয়ানমারের সাথে যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটা আছে, চীনের সাথে আছে, ভারতের সাথে আছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে।
রোহিঙ্গারা চাকমাদের মতো বাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠী নয়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের। তাদেরকে মিয়ানমারেই ফিরে যেতে হবে।
পরিচিতি: আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান