রায়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার প্রয়াস জনগণ মেনে নেবে না
ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ন্যস্ত করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সম্প্রতি কিছু পর্যবেক্ষনসহ এ সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়েছেন। রায়ে সংসদ, সংসদ সদস্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সরকার পরিচালনা, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ, জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষন দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সংবিধানের অভিভাবক সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে সারাদেশে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষনকে প্রবীণ আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন। রায় প্রকাশের পর থেকে দেশব্যাপী আইনজীবীদের মধ্যেও পর্যবেক্ষন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতৃত্বে সারাদেশে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা, সংবাদ সম্মেলনসহ ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছে। সময়ই বলে দেবে এই রায়ের সঙ্গে দেওয়া পর্যবেক্ষণগুলো কতটুকু প্রাসঙ্গিক ছিল। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করেন আর আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও পরিবর্তনের কাজ সংসদের। ফলে রায়ে উল্লেখিত বিতর্কিত পর্যবেক্ষণ অনাকাক্সিক্ষত।
মাজদার হোসেন মামলার আলোকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আইনজীবী ও জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের বদৌলতে এই স্বাধীনতা এসেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তরান্বিত হয়েছে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে দেশের বিচার বিভাগ বেশি স্বাধীন। অথচ রায়ে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনা হয়েছে! সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৬ অনুযায়ী নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি, নিয়োগ, বদলি সম্পর্কিত ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকায় সমালোচনা করা হয়েছে। আর বিচার বিভাগের তথাকথিত স্বাধীনতার কথা বলে বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদ থেকে নিয়ে অস্বচ্ছ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে নেওয়া হয়েছে। সংসদে আইনমন্ত্রী বলেছেন, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা যতদিন সংসদের হাতে ছিল একজন বিচারপতিও অপসারণ হয়নি। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করার পর অনেক যোগ্য ও দক্ষ বিচারপতি যেমন- আব্দুর রহমান চৌধুরী, কে এম সোবহান, দেবেশ ভট্টাচার্যকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমি বলতে চাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলেরই পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস রয়েছে।
৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপোসহীন নেতৃত্বে স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অত্যাচারী পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। তাছাড়া বর্তমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তো জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এদেশের মানুষ পাকিস্তানের নির্মম অত্যাচারের কথা ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি দুই লক্ষ মা-বোনকে লাঞ্ছনার ইতিহাস। সেই বিবেচনায় পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে প্রধান বিচারপতি যে মন্তব্য করেছেন তা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি।
বাংলার স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে দুই যুগের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুকে ১৪ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। বারবার অবিসংবাদিত এই নেতাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছে পাকিস্তানি জান্তা সরকার। ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘গঁলরন রিষষ হড়ঃ মড় ঁহঢ়ঁহরংযবফ’ হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট বা অন্যকোনো আদালত বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা উপাধি দেয়নি। পাকিস্তানি জান্তা সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বারংবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম বলবত রেখেছিলেন বলে স্বাধীন বাংলার মানুষই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে সম্মানিত করেছেন। কাজেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে ষোড়শ সংশোধনী রায়ে খাটো করে দেখার যে প্রয়াশ চালানো হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ তা মেনে নেবে না।
পরিচিতি: সাবেক সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি এবং সাবেক সদস্য, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ড. বদরুল হাসান কচি
সম্পাদনা: আশিক রহমান