নিস্বর্গসখা মিশে গেলেন নিস্বর্গেই
শেলী সেনগুপ্তা
চলে গেলেন প্রকৃতির বন্ধু। আমরা হারালাম একজন শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক ও প্রকৃতিবিদ। বলছি সেই মানুষটির কথা যার গভীর চিন্তাসম্পন্ন বক্তি ‘জীবনে যা কিছু পয়োজনীয় তা চোখে দেখা যায় না’। বলেছিলেন নিস্বর্গসখা দ্বিজেন শর্মা। যখন সাধারণ মানুষ ব্যস্ত দৃশ্যমান জগত নিয়ে তখন তিনি কান পেতে শোনেছেন প্রকৃতির কথা, পাতার কম্পন, ফুলের অনুরণন। জীবনকে দেখছেন প্রকৃতির তাল ও ছন্দে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর দ্বিজেন শর্মার আজীবন সাধনার বিষয় ছিল মানুষ ও নিস্বর্গ। স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে তার গবেষণার বিষয় ছিল নতুন প্রজাতির শৈবাল সন্ধান। কিন্তু তিনি উচ্চতর শিক্ষা বা গবেষণার সুযোগ পাননি। এর পেছনের কারণও মানববন্দনা। তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতায় অতিবাহিত করেন এবং স্বার্থক শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। বেশ অনেক বছর তিনি নটর ডেম কলেজে পাঠদান করেন। যারা সরাসরি তার কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করেছে আর যারা তাকে একলব্যের মতো গুরু আসনে বসিয়েছে তারা কেউই তাকে কখনো ভূলতে পারবে না। মনের মনিকোঠায় তিনি সারাজীবন প্রদীপের আলো হয়ে বিরাজ করবেন।
জীবনের একটা বড় সময় তিনি পার করেছেন অনুবাদ কর্মে। তার অনূদিত শিল্পসাহিত্য, মার্ক্সবাদ, ইতিহাস, শিশুসাহিত্য এক বিশাল সংখ্যক পাঠকের জ্ঞানের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। অনুবাদ কর্মের জন্য তিনি দীর্ঘদিন সপরিবারে মস্কোতে বসবাস করেন। তাকে ইতিহাসের মাইলফলকও বলা যায়। একজীবনে অনেক কিছুই দেখেছেন। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতনও দেখেছেন তিনি। বিশ্বপরিবেশের বিপর্যয় বা সভ্যতার সংকট দেখেও তিনি হতাশ হননি। শুধু মানুষের জীবনের সঙ্গে এর সমন্বয়ের উপায় খুঁজেছেন আপন চেতনায়। এ সময় যেন তার কলম আরও ক্ষুরধার হয়ে উঠেছিল। পাঠক পেয়েছিল সুন্দর জীবনের দিকনির্দেশনা। তিনি যখন মস্কোতে ছিলেন তখন তার বাসস্থান ছিল মস্কোতে পড়তে যাওয়া বাঙালি শিক্ষার্থীদের আপন আলয়। এখানেই তারা খুঁজে পেত পরিবারের উষ্ণতা। বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিকরাও এখানে পেতেন হৃদয় জুড়ানো ভালোবাসা। শর্মা দম্পতির আবাসভূমি ছিল সবার জন্য অবারিত।
দ্বিজেন শর্মা নিস্বর্গপ্রেমিক যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন মানবপ্রেমিকও। মানুষের জন্য তার ভালোবাসা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত। কখনো কেউ তার কাছ থেকে বিমুখ হয়ে ফেরেনি। তেমনি প্রাণী কূলের জন্য তার অন্তরে ছিল সমান স্নেহবোধ। একসময় কুকুরও তার সাহিত্যের উপজীব্য হয়েছে। ‘আদিসখা চিরসখা’ নিবন্ধটি লিখেছেন কুকুর নিয়ে।
পোষা কুকুরের মৃত্যু তাকে অনেক বেদনার্ত করেছে, যার পকাশ ঘটেছে তার সাহিত্যকর্মে। জীবনকে তিনি খুব ভালোবেসে দেখেছিলেন। জীবন ছিল তার কাছে গভীর উপলব্ধির বিষয়। সমাজতন্ত্রের পতনকে তিনি দেখেছেন মানবসভ্যতার জন্য গভীর সংকট হিসেবে। পকৃতিকে অবদমন করে মানব উন্নয়নের ধারা পবাহিত হচ্ছে, প্রকৃতি যখন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখন মানুষ হতবাক হয়ে যায়। কিছুই করার থাকে না। পুঁজিবাদও পারে না তা থেকে মুক্ত করতে।
বিশ্বমানবপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মার নিজ দেশের প্রতি ছিল দৃঢ় বন্ধন। দীর্ঘদিন মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের কাজ করার পর দেশে ফিরে আসেন। এবার তিনি নিজের লেখা-লেখির মাত্রা বাড়িয়ে দেন। তিনি ৩০টিরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। এ সময় তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকল্পের বাংলা পিডিয়ার অন্যতম সম্পাদক ছিলেন।
এই বাংলাতে গুণীর কদর সবসময়। তার মননশীল লেখা-লেখির জন্য ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৫ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতির সন্তানটি অন্তরে মিশে গেছেন। যদি তার মতো করে বলতে পারতাম ‘জীবনে যা কিছু প্রয়োজনীয় তা চোখে দেখা যায় না’, তাহলে হয়তো আমরাও তাকে আমাদের মাঝে খুঁজে পেতাম। তারপরও বিশ্বাস করি তিনি আছেন, আমাদের মাঝেই আছেন আমাদের ভালোবেসে। নিস্বর্গসখার স্থিতি হয় নিস্বর্গের মাঝেই।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট