রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমরা কতটুকু তৎপর
রোহিঙ্গারা বংশ পরম্পরায় দীর্ঘ এক হাজার বছর যাবৎ বার্মার আরাকান প্রদেশে বসবাস করে আসছে। আরাকান একদা মুসলিম শাসনাধীন স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন দ্বারা বার্মাকে ভারতবর্ষ হতে পৃথক করা হয়। তদপরবর্তী বৃটিশ শাসনাধীন থাকাবস্থায় আরাকানে ভয়াবহ দাঙ্গা সংগঠিত হয়। উক্ত দাঙ্গায় রোহিঙ্গারা ব্যাপক হারে মগ তথা রাখাইনদের দ্বারা হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের শিকার হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশদের নিকট হতে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করলে তখনকার শাসক বার্মার বর্তমান তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী সুচি’র পিতা অংসান আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
অংসান সামরিক বাহিনী দ্বারা নিহত হওয়া পরবর্তী উনু ক্ষমতাসীন হলে তিনিও অংসানের ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার স্বীকার করে নেন। নেউইন এর শাসনামলে তিনি সর্বপ্রথম রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দানে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। নেউইন ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ১৯৬২খ্রিস্টাব্দে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আরাকান ত্যাগে বাধ্য হয়ে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে আগমন করেন এবং এদের কেউই পরবর্তীতে আরাকানে প্রত্যাবর্তন করেন নি। বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরবর্তী ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অত্যাচার ও নিষ্পেষণের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশে বাধ্য হয়। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির অধীন এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর প্রত্যাবর্তন শুরু হলেও তা মাঝপথ থমকে যায়। এ চুক্তিটিতেও রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমিতে অত্যাচার ও নিষ্পেষণের শিকার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটতে থাকে। এভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৫ লক্ষ অতিক্রম করে। সাম্প্রতিক সময়ে অত্যাচার ও নৃশংসতার মাত্রা অতীতের সকল ইতিহাসকে ছাড়িয়ে গেলে পুনঃ ব্যাপকহারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে যা এখনো অব্যাহত আছে। এভাবে অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা যে দশ লক্ষ অতিক্রম করবে এমনই ধারণা পাওয়া যায়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর পরিচালিত দুটি শরণার্থী শিবিরে বর্তমানে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার কিন্তু এর বাইরে কক্সবাজার ও বান্দরবানে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। এ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ বর্তমানে যারা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে এদের নাম ও ঠিকানা বাংলাদেশের কোনো সংস্থা লিপিবদ্ধ করছে না। অতীতের ন্যায় বর্তমানেও যদি শরণার্থী হিসেবে অনুপ্রবেশকারীদের নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করা না হয় তাহলে সময়ের পরিক্রমায় তারা একসময় এ দেশের মূল ¯্রােতের নাগরিকদের সঙ্গে মিশে যাবে এবং সেক্ষেত্রে এদের প্রত্যাবর্তন দূরহ হবে।
ইতোপূর্বে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে অনুপ্রবেশকারী বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা এ দেশের এক শ্রেণীর অসাধু লোকের সহায়তায় বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহপূর্বক পাকিস্তান সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এ দেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা নাগরিক বিদেশের মাটিতে কোনো অপরাধ করলে তা বাংলাদেশের জন্য অপমান ও লজ্জার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। অতীতে বাংলাদেশে যে সকল রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে এবং বর্তমানে যারা অনুপ্রবেশ করছে এদের সকলের নিবন্ধন অত্যন্ত জরুরি। নিবন্ধনের কাজটি সুষ্ঠু ও সূচারুরূপে সমাধা করা গেলে বাংলাদেশের পক্ষে এদের সংখ্যানুযায়ী জাতিসংঘসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের বাংলাদেশে অবস্থানকালীন সাহায্য ও সহযোগিতা এবং নিজ মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন সহজতর হবে। বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে যে হারে রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল সে তুলনায় প্রত্যাবর্তনের সংখ্যা নগণ্য। বর্তমানে তথায় যে পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিরাজ করছে তা প্রত্যাবর্তনের জন্য মোটেও অনুকূল নয়। তাছাড়া বার্মার সামরিক শাসকরা রোহিঙ্গাদের তথাকার নাগরিক হিসেবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনপূর্বক প্রত্যাবর্তন দূরের কথা প্রতিনিয়ত বিতাড়নে বাধ্য করছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক বল প্রয়োগ ব্যতিরেকে বাংলাদেশের পক্ষে এককভাবে বার্মার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
নাগরিকত্ব বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী রোহিঙ্গারা যে কোনো মাপকাঠিতে বার্মার নাগরিক। বার্মা কর্তৃক অভিনব শর্তারোপের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে অত্যাচার ও নিষ্পেষণের মাধ্যমে তাদের নিজ মাতৃভূমি হতে বিতাড়ন অমানবিক, পৈশাচিক ও বর্বরোচিত। এ ধরণের পৈশাচিকতা ও বর্বরতা কোনো সভ্য দেশ ও জাতির পরিচায়ক নয়।
বার্মা বাংলাদেশের প্রতিবেশী এবং নিজেকে বাংলাদেশের বন্ধু বলে দাবি করে। একটি বন্ধুরাষ্ট্র কখনো নিজ দেশের নাগরিককে অত্যাচার ও নিষ্পেষণের মাধ্যমে অপর বন্ধুদেশে প্রবেশে বাধ্য করতে পারে না। বার্মা যখন বন্ধুত্বের চরম অবমাননায় তার নিজ দেশের নাগরিকদের বলপূর্বক বাংলাদেশে প্রবেশে বাধ্য করে বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে তখন দেখা গেল বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রী সস্ত্রীক বার্মায় গমনপূর্বক চাল আমদানির চুক্তি চূড়ান্তকরণে ব্যস্ত। এ ধরণের চুক্তিপত্র স্বাক্ষরে সচরাচর খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অথবা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন। বার্মার সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যখন সর্বনি¤œ পর্যায়ে এমন অবস্থায় খাদ্য মন্ত্রীর সস্ত্রীক তথায় চাল আমদানির চুক্তি স্বাক্ষরে গমন আমাদের জন্য জাতি হিসেবে একদিকে অবমাননাকর অপরদিকে বড় ধরণের কূটনৈতিক বিপর্যয়। যে কোনো দেশের নাগরিকদের তাদের ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, অত্যাচার ও নিষ্পেষণের সম্মুখীন করলে তারা আত্মরক্ষা বা বাঁচার শেষ অবলম্বন হিসেবে সশস্ত্র পন্থা গ্রহণে বাধ্য হয়। বার্মার শাসকরা দীর্ঘকালযাবৎ যেভাবে আরাকানের রোহিঙ্গাদের জন্মগত অধিকার হতে বঞ্চিত করে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত করছে তাতে সার্বিক বিবেচনায় প্রতীয়মান হয় তাদের জন্য সশস্ত্র পন্থা অবলম্বন অবশ্যসম্ভাবী হয়ে উঠেছে। আর তাই জাতিসংঘসহ পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ রোহিঙ্গাদের জন্মগত নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বার্মাকে সম্মত করাতে ব্যর্থ হলে তাদের উচিত হবে সশস্ত্র পন্থা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে তারা যেন তাদের হারানো অধিকার পুনরুদ্ধার করে স্বীয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনপূর্বক তথায় আত্মসম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পারে তার নিশ্চিয়তা বিধান। বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্ররূপে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে সাময়িক আশ্রয়দাতা দেশ বিধায় এক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৎপরতা হতে হবে অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক এমন সকল কাজে সার্বিক সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারণ।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ঊ-সধরষ: রশঃবফবৎধযসবফ@ুধযড়ড়.পড়স