আজানের সূচনা
মাহফুয আহমদ
মুসলমানদের ওপর মক্কায় মুশরিকদের অকথ্য নির্যাতন আর অসহ্য নিপীড়নের কারণে শান্তিতে জামাত সহকারে নামাজ আদায়ের সুযোগ হয়নি। সেজন্য সেখানে আজানেরও প্রয়োজন দেখা দেয়নি। বস্তুত আজান অর্থই হচ্ছে জানানো, অবগত করা বা ঘোষণা দেয়া। যেহেতু মদিনায় মুসলমানদের নিজেদের ক্ষমতা ও সামর্থ্য ছিল, তারা শান্তিতে বসবাস করতে পেরেছিলেন, সংখ্যাও ছিল বেশ এবং নিজেদের মসজিদ ছিল, সেজন্য এখানে আজানের প্রয়োজন দেখা দেয়। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মুসলমানগণ মদিনায় আগমনের পর নামাজের সময় অনুমান করে মসজিদে সমবেত হতেন। (সে সময়) কেউ নামাজের জন্যে আহ্বান করত না। একদিন তাঁরা এ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। তখন কিছু সাহাবি বললেন, খ্রিস্টানদের মতো ঘণ্টা বানিয়ে নাও। অপর কয়েকজন বললেন, ইহুদিদের শিঙ্গার মতো শিঙ্গা (বানিয়ে নাও)। এ সময় হজরত ওমর (রা.) বললেন, আপনারা একজন ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দেন না; যিনি নামাজের আহ্বান করবেন? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে বিলাল! তুমি দাঁড়িয়ে নামাজের আহ্বান কর। (সহিহ বুখারি: ৬০৪, সহিহ মুসলিম: ৩৭৭)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যায়দ ইবনে আবদে রাব্বিহি (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শিঙ্গা ধ্বনি করে লোকদের নামাযের জন্যে একত্র করার নির্দেশ প্রদান করলেন, তখন একদা আমি স্বপ্নে দেখলাম, এক ব্যক্তি নিজ হাতে একটি শিঙ্গা বহন করে নিয়ে যেতে দেখে আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! আপনি কি শিঙ্গাটি বিক্রি করবেন? তিনি প্রশ্ন করলেন, শিঙ্গা দিয়ে তুমি কী করবে? বললাম, এটা দিয়ে আমরা নামাজের প্রতি আহ্বান করব (আজান দিব)। তিনি বললেন, আমি কি এর চেয়ে উত্তম কোনো বস্তুর সন্ধান দেব না? বললাম, অবশ্যই। তিনি বললেন, তুমি বলবে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার …’ তিনি (পূর্ণ) আজান ও ইকামত উল্লেখ করলেন। তিনি বলেন, যখন আমি ভোরে ওঠলাম তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে যা দেখে ছিলাম তার বিবরণ পেশ করলে তিনি ইরশাদ করলেন, এটা অবশ্যই সত্য স্বপ্ন। তুমি বিলালের সাথে দাঁড়াও। আমি তাকে এগুলো শিখাতে লাগলে তিনি আজান দিতে থাকলেন। তিনি বলেন, হজরত ওমর (রা.) তা শুনলেন, তখন তিনি ঘরে ছিলেন- চাদর টানতে টানতে বের হয়ে এসে বললেন, আল্লাহর রাসূল! আপনাকে যে সত্ত্বা সত্য দিয়ে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! আমিও ওইরূপ স্বপ্ন দেখেছি যেরূপ স্বপ্ন তিনি (আবদুল্লাহ ইবনে যায়দ) দেখেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯) এর সনদ সহিহ।
আজানের এই শব্দগুলো হিজরতের কোন বৎসর শিখানো হয়েছিল- এ সম্পর্কে হাফিয ইবনে হাজার (রহ.) এর মত হচ্ছে ২য় বৎসর আর আল্লামা আইনি (রহ.) এর মতে ১ম বৎসর। বস্তুত ইমাম বোখারি (রহ.) এর দৃষ্টিভঙ্গিও এটাই যে, হিজরতের পরপরই এ ঘটনা ঘটেছে। তিনি এ ক্ষেত্রে কোরআনে কারিমের এই আয়াত ‘মোমিনগণ, জুমআর দিনে যখন নামাযের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর।’ (সূরা আল জুমা: ৯) দ্বারা দলিল পেশ করেন। এখানে জুমার নামাজের জন্যে আজানের কথা বলা হয়েছে আর জুমা তো হিজরতের পরপরই ফরজ হয়ে গিয়েছিল। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার যে, কিছু কিছু ভ- পীর এ ধরনের বর্ণনা থেকে স্বপ্ন শরিয়তের দলিল সাব্যস্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে থাকে। এটা সম্পূর্ণ অবাস্তব। কেননা, আজান আমাদের কাছে স্বপ্ন দ্বারা শরিয়তসিদ্ধ হয়নি, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘এটা অবশ্যই সত্য স্বপ্ন’ উক্তি দ্বারাই তা শরিয়তসিদ্ধ হয়েছে। কোনো কোনো জাহিল সূফি হাদিসের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য স্বপ্নকে মানদ- মনে করে! এটা একেবারে ভিত্তিহীন কথা।
ইমাম নাওয়াওয়ি (রহ.) বলেন, “স্বপ্নের ভিত্তিতে কোনো প্রমাণিত হাদিস বাতিল হতে পারে না এবং কোনো অপ্রমাণিত হাদিস স্বপ্নের ভিত্তিতে প্রমাণিত হতে পারে না। এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে।” (শারহে সহিহ মুসলিম, ১/১৮) এ বিষয়ে ড. ইউসুফ কারযাবি’র ‘মাওকিফুল ইসলাম মিনাল ইলহাম ওয়াল কাশফি ওয়ার রুইয়া’, মাও. আবদুল মালেক সাহেবের ‘আত তাসাওউফ বাইনা আরযিন ও নাকদিন’ (তাসাওউফ তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ) এবং তাঁরই লিখিত প্রচলিত জাল হাদিসের ভূমিকা প্রভৃতি গ্রন্থ অধ্যয়ন করা যেতে পারে। অবশ্য নবীগণ ব্যতীত সাধারণ মানুষের স্বপ্ন সুসংবাদ ও শুভলক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, তবে শরিয়তের কোনো বিধান প্রমাণে বা খ-নে স্বপ্ন কখনও দলিল হতে পারে না। আর ইসলামে তো কুলক্ষণের ধারণাই অনুচিত।