ইসলামি সন-তারিখের তাৎপর্য ও ইতিহাস
মোস্তফা কামাল গাজী
তারিখ শব্দটি আরবি। এর প্রচলিত অর্থ ইতিহাস, বছরের নির্দিষ্ট দিনের হিসাব। আল্লামা ইবনে মানজুর (রহ.) তাঁর বিখ্যাত আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ লিখেছেন, ‘তারিখ হলো, ‘সময়কে নির্দিষ্ট করা, সময়ের চিত্র তুলে ধরা, সময়ের ঘটনাপ্রবাহ শব্দবদ্ধ করা। দৈনন্দিন জীবনে সন-তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। সন-তারিখ মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংখ্যার গণনা, হিসেব রক্ষণ, মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগির সময় নির্ধরণ ইত্যাদির জন্য তারিখ ও সনের প্রচলন অতি গুরুত্বপূর্ণ। সন-তারিখের প্রচলন সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। আদিকাল থেকেই মানুষ সন-তারিখের সমন্বয়ে নিজেদের জীবন পরিচালনা করে আসছে। হজরত ইবনে কাসির (র.) এর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল কামেল ফিত তারিখে’ লিখেন, ‘ইসলাম আসার আগে আরবের সমষ্টিগত কোনো তারিখ ছিলো না। সে সময় তারা প্রসিদ্ধ ঘটনা অবলম্বনে বছর ও মাস গণনা করতো। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর সন্তানরা কাবা শরিফ নির্মিত হওয়ার আগে তাঁর আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনা অবলম্বনে তারিখ নির্ধারণ করতো। কাবা শরিফ নির্মাণের পর তারা বিক্ষিপ্ত হওয়া পর্যন্ত এ অনুযায়ী সাল গণনা করতো। এরপর তাঁর বংশধর থেকে যারা হেজাজের তেহামা অঞ্চল থেকে বেরিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়, তখন সেই গোত্র বেরিয়ে যাওয়ার দিন থেকে তারিখ গণনা শুরু করে। যারা তেহামাতে রয়ে যায়, তারা বনি জায়েদ গোত্রের জুহাইনা, নাহদ ও সা’দের চলে যাওয়ার দিন থেকে সাল গণনা করে। কাব বিন লুআইয়ের মৃত্যু পর্যন্ত এ ধারা চলমান ছিল। পরে তাঁর মৃত্যুর দিন থেকে নতুনভাবে সাল গণনা শুরু হয়। এটা চলতে থাকে হস্তীবাহিনীর ঘটনা পর্যন্ত। হিজরি বর্ষের গোড়াপত্তন হওয়ার আগ পর্যন্ত আরবে ‘হস্তীবর্ষ’ই প্রচলিত ছিলো। (আল কামেল ফিত তারিখ লি ইবনিল আছির : ১/৯)
বনু ইসমাইল ছাড়া আরবের অন্য গোত্রের লোকেরা নিজেদের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে উপলক্ষ করে বর্ষ গণনা করতো। এরপর ইসলাম আসে মুক্তির সুমহান বার্তা নিয়ে। দিকে দিকে যখন ইসলামের জয়জয়কার, পৃথিবীজুড়ে ছড়রিয়ে পড়ে ইসলামের সত্য বাণী তখন মুসলমানদের কল্যাণার্থে ও সংখ্যা গণনার প্রয়োজনে হিজরি সনের প্রবর্তন করা হয়। তখন ছিলো ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.) এর খিলাফতকাল। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) তখন ছিলেন ইরাক ও কুফার গভর্নর। তিনি একদিন খলিফার কাছে এ বলে আবেদন পাঠালেন যে, আমিরুল মুমিনিনের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় যেসব ফরমান এবং বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়, তাতে কোনো সন-তারিখ উল্লেখ না। তাই এটা কোন দিনের আদেশনামা তা অবগত হওয়া যায় না। ফলে সেটা কার্যকর করতে জটিলতায় পড়তে হয়।
খলিফার দরবারে পত্র পৌঁছুলে তিনি তা পড়ে অনুধাবন করলেন যে, আবু মুসা আশয়ারি (রা.) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি দেরি না করে কয়েকজন সাহাবির (রা.) সঙ্গে পরামর্শে বসে উল্লিখিত বিষয়টি উপস্থাপন করলেন। তিনি বললেন, মুসলিম জাতির সুবিদার্থে একটি ইসলামি সন-তারিখ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সবাই এতে সম্মতি দিলেন এবং দিন, তারিখ ও সন নির্ধারণ কোন দিনকে কেন্দ্র করে হবে সে ব্যাপারে নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করলেন। কেউ বললেন, প্রিয় নবিজীর (সা.) জন্মগ্রহণের মাস থেকে ইসলামি সন গণনা শুরু হোক। কেউ বললেন, ইন্তেকালের মাস থেকে। কারো কারো মত ছিল নবুওয়াত প্রাপ্তির মাস থেকে শুরু হোক। বিভিন্ন মতামত শোনার পর হজরত ওমর (রা.) ভেবে দেখলেন, নবজী (সা.) এর জন্মগ্রহণের মাস থেকে ইসলামি সন চালু করা যায় না। কারণ খ্রিস্টানরা হজরত ইসা (আ.) এর জন্মগ্রহণের মাস থেকে তাদের ইসায়ী সন শুরু করেছে। এজন্য তাদের সাঙ্গে সাদৃশ্য আমাদের উচিত হবে না। আর প্রিয় নবীজির (সা.) এর ওফাত যেহেতু আমাদের জন্য শোক ও দুঃখের, এমন করুণ স্মৃতি সজীবতা লাভ করলে জাহেলি যুগের অন্ধ প্রথা জীবিত হয়ে উঠবে এবং মৃত্যুদিবস পালিত হবে। আর নবুওয়াতের মাস থেকে শুরু করলেও অসুবিধা দেখা দেবে। কারণ, নবী-রাসুলগণের জীবন দুই প্রকার। এক. শারীরিক জীবন, দুই. আত্মিক জীবন। দুনিয়ায় জন্মগ্রহণের পর থেকে শুরু হয় শারীরিক জীবন, আর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর শুরু হয় আত্মিক বা রূহানি জীবন। নবুওয়াতের সময় থেকে সন গণনার বিষয়টি যদিও খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, তবু খ্রিষ্টানরা যেহেতু হজরত ইসা (আ) এর শারীরিক জীবন থেকে ইসায়ী সন চালু করেছে, তাই রাসুলুল্লাহ (সা.)এর নবুওয়াতি জীবন থেকে ইসলামি সন করাটা সমীচীন হবে না।
হজরত ওমর (রা.) এর ভাবনায় হিজরতের মাহাত্ম্য ও গুরুত্বের কথা জাগ্রত হয়। এ বিষয়গুলো খুলে বললেন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর কাছে। হজরত ওমর (রা.) বলতেই হজরত ওসমান ও হজরত আলি (রা.) তাঁর কথার প্রতি সমর্থন করে বললেন, আমাদের হিজরি সন স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া জরুরি। তাই ইসলামের ঐতিহাসিক ঘটনা হিজরতের সময় থেকে এর গণনা শুরু হোক। সবার কাছে প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হলে এবং ব্যাপক সাড়া পেলে মদিনায় হিজরতের সময় থেকেই গণনা শুরু হয় ইসলামি সন। আর হিজরতকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়ায় এর নাম রাখা হয় হিজরি সন। নবিজী (সা.) যখন হিজরত করেন তখন ছিলো রবিউল আউয়াল মাস। কিন্তু মহররম মাসে বিভিন্ন ঘটনা ঘটার কারণে মুসলমাদের মাঝে এর গুরুত্ব অনেক। ইসলামপূর্ব যুগেও এ মাসের অনেক কদর ছিলো। তাই মাসের ধারাবাহিকতা ও সার্বিক দিক চিন্তা করে মহররমকেই হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়। মুসলিম উম্মাহর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছি হিজরি সন। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, ঈদ উৎযাপন, আশুরা ইত্যাদির দিনক্ষণ নির্ণয় হয় হিজরি মাস অনুযায়ী। এ ছাড়াও বিভিন্ন চন্দমাসে রয়েছে অনেক ফজিলতপূর্ণ আমল। তার সঠিক হিসাব না রেখে আমল করলে সকল কষ্ট ভেস্তে যাবে। তাই হিজরি সনের সঠিক হিসাব রেখে পালন হবে প্রতিটি আমল।