ওরাই আগামী, ওদের মানুষ করো
যে বয়সে বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, মাঠে খেলার কথা, সেই বয়সের কিশোররা এখন ছুরি-চাকু এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাস্তানি করে, মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। মেয়েদের দিকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে, শিস দিয়ে থাকে। বাঁধা দিলে রক্তারক্তি, খুনাখুনি করে। যে বয়সের কিশোর ছেলেটা শিক্ষামূলক বিতর্কের টেবিলে ঝড় তোলার কথা ছিল, তাকে যখন ধর্ষণের দায়ে হাতকড়া পরে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, এই দৃশ্য দেখাটা শুধুমাত্র কোনো বাবা মায়ের জন্য কষ্ট বা লজ্জার নয়, এ লজ্জা আমাদের সবার। এই কিশোর অপরাধ ক্রমেই বেড়ে চলছে। কিশোর খুনি বা অপরাধীদের মধ্যে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বস্তির বাসিন্দা কিশোররাও। কিশোর অপরাধ নিয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। কিশোরদের এভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার কারণ খুঁজতে গিয়ে যা পাওয়া যাচ্ছে তা রীতিমতো ভয়ের কারণ। পরিবার তথা সমাজের সবার জন্য অশনি সংকেতও বটে। এ ব্যাপারে এখনই সবাইকে সতর্ক না হলে আমাদের সামনে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। কিশোর অপরাধের জন্য মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করা হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দূর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষার অভাবই এর জন্য দায়ী। সন্তানের শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের প্রতি অভিভাবকের যতটা মনোযোগ দেয়া দরকার প্রায়ই তা দেয়া হয় না। সন্তান যা চায়, তাই দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করতে চায় বাবা-মা। চালকের লাইসেন্স না থাকলেও তার হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেয়া হয়। মোটর সাইকেল কিনে দেয়া হয় শখ করে। এরাই রাস্তায় রীতিমতো ত্রাসের সৃষ্টি করে। দুর্ঘটনাও ঘটায় অহরহ। রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। কিন্তু সেই অভিভাবকরা সন্তানের কোনো অপরাধই দেখতে পান না। যার ফলে এরা বাড়তে বাড়তে এক সময় জড়িয়ে যায় কুচক্রের জালে।
মাদকবিক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত অনেকেই নিজের সামান্য লাভের আশায় কিশোরদের অপরাধ জগতে টেনে নেন। অপরাধমূলক কর্মকা-ে কিশোরদের ব্যবহার করেন। ফলে এক সময় এই কিশোররা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরা হয়ে ওঠে নেশাগ্রস্ত ও সম্পূর্ণভাবে এক অপরাধী। আর তখন শুধু পাড়া-পড়শির নয়, নিজের পরিবারের জন্যও তারা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সর্বশেষ এমনই এক খুনের ঘটনা ঘটে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। কিছুদিন আগে এক রাতে একদল কিশোর তাদের প্রতিপক্ষের এক কিশোরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। এতে বাঁধা দেওয়ায় জাহিদুল নামে আরেক কিশোরকে তারা খুন করেছে। এলাকাবাসী অনেকে বলছেন, ১৩ থেকে ১৭ বছরের এই কিশোরদের ভয়ে তারা সারাক্ষণ তটস্থ থাকেন। উত্তরা, তেজগাঁওসহ রাজধানীতে এর আগেও এরকম বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশের তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী শুধু ঢাকা মহানগরীতেই কিশোর অপরাধীর সংখ্যা ছিল পাঁচ শতাধিক, যদিও বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক বেশী বলে ধারণা করা হয়। চুরি, ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধকে পিছনে ফেলে কিশোরদের খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা ক্রমেই বাড়তে থাকার পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করার সময় এখনই। দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামী। আর নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশীর ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। আর এরা এসেছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকেই। এখন প্রশ্ন একটাই, অল্প বয়সী এই কিশোরেরা কেন ভয়ংকর এই পথে হারিয়ে যাচ্ছে? এর দায় কি শুধু বাবা-মায়ের, নাকি পরিবার, চারপাশের পরিবেশ, সমাজের, রাষ্ট্রের, সরকারের? কে নেবে এদের দায়িত্ব? এমনি করে আমাদের সন্তানেরা অপরাধের জালে জড়িয়ে কিশোর বয়সেই হারিয়ে যাবে তাতো হতে পারে না। কিছু একটা করতেই হবে এবং সবাই মিলেই করতে হবে।
কিশোর অপরাধীদের মধ্যে বস্তিবাসী ও নি¤œ আয়ের পরিবারের কিশোরেরা দারিদ্র্যের কারণে মফস্বল থেকে বড় শহরে আসা কিশোরেরা সমাজে টিকে থাকার জন্যে এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে অপরাধে জড়াচ্ছে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পেছনে স্থানীয় ‘বড়ভাই’ দের রাজনৈতিক মদদ রয়েছে। রয়েছে মাদক বাণিজ্যের লোভনীয় ফাঁদ। সেই সঙ্গে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতার উদাহরণও রয়েছে। আকাশ সংস্কৃতির যুগে প্রযুক্তির অপব্যবহার তো আছেই। সব মিলিয়ে বেসামাল পরিস্থিতিতে আমাদের বাচ্চারা।
সবকিছুর পরেও জীবন বড় সত্যি। হাজারো প্রতিকূলতা পাশকাটিয়ে টিকে থাকার নামই জীবন। প্রত্যেকেরই নিজে এবং তার চারপাশকে সুস্থ্য-সুন্দর রাখতে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করা ও ছেলেমেয়েদের সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করা উচিৎ। অভিভাবক হিসেবে কোনটা ভুল কোনটা সঠিক, জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা সন্তানদের দেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। সন্তান জন্ম দেয়াই বড় সার্থকতা নয়, মানুষের মতো মানুষ করতে পারাটাই সার্থকতা। তাই নিজের জানার জগৎ সীমিত থাকলেও সন্তানদের সঠিক নির্দেশনা দিতে গিয়ে ভুল করা যাবে না। পরিবারই একটা শিশুকে সম্পর্কের গুরুত্ব বোঝাতে পারে। চোখে চোখ রেখে বিনয়, আর্দশ, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও রুচির প্রথম বীজটা বপন করে দিতে পারে শিশুর মধ্যে। এক ক্লিকেই সব যখন চোখের সামনে, সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না বরং বাচ্চার ফোকাসটা নির্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলটা অভিভাবকের জানা থাকতে হবে। হাজারো কাজ থাকলেও বাচ্চাকে সময় দিতে হবে এবং তার দায়িত্ববোধ, পারিপার্শ্বিকতা ও প্রয়োজন সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান দান করতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকগণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাচ্চাদের সঠিক ভাবে মানুষ করার ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকার তুলনা হয় না। মোট কথা, কিশোর অপরাধ বন্ধ করতে হলে সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন, অভিভাবকসহ চার পাশের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। কিশোরদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারলে আমরা উন্নত রাষ্ট্র গড়বো কিভাবে? তাই অবিলম্বে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন
সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ