ওপারে সহিংস সু চি, এপারে মানবিক শেখ হাসিনা
ওপারে সহিংস মিয়ানমার, এপারে মানবিক বাংলাদেশ। সত্যি এ এক অন্য বাংলাদেশকে চিনেছে বিশ্ব। লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে ‘মানবিক বাংলাদেশে’ আশ্রয় নিচ্ছে। ইতোমধ্যে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়েছে। কক্সবাজার আর বান্দরবানের রোহিঙ্গা পাড়া যেন ভালোবাসার চাদরে ঢেকে গেছে। রোহিঙ্গা, মুসলিম, হিন্দু বা রাখাইনদের জাতিসত্তার পরিচয় ভুলে গেছে বাংলাদেশ। ‘মানুষ’ রোহিঙ্গাকে আগলে রাখতে যারপরনাই উদার হয়েছে বাঙালি আর বাংলাদেশ। সরকারের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন আর ব্যক্তি। লাখো প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের প্রাণ আজ উদ্বেলিত।
এদিকে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা দমনপীড়ন শুরু হওয়ার ২৪ দিন পর মঙ্গলবার মুখ খুলেন স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি সহিংসতা ও শরণার্থী সংকট নিয়ে কথা বলেন। তিনি ঔদ্ধত্যের সুরে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণ মিয়ানমার ভয় পায় না।’ ভাষণে সু চি বলেন, রোহিঙ্গারা পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছে। তবে সরকার শান্তি বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
তবে তিনি যে অনেক কথাই সত্য বলেননি, সে দাবি বিবিসির দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রতিনিধি জনাথন হেডের। সু চি বলেছেন, রাষ্ট্রের আইনের বিরুদ্ধে যারা যাবে ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে, তাদের ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর প্রেক্ষাপটে বিবিসির সাংবাদিক বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহারের ইতিহাস ৭০ বছরের বেশি। রাখাইন রাজ্যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো সেনা কর্মকর্তা সুশৃঙ্খল আচরণ করেছেন, এমন নজির নেই। আর এখন তো তাদের অভিযানের মুখে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সু চি বলেছেন, রাখাইনে বসবাসকারী সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সমান সুযোগ পায়। কেউ কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার হয় না। এ ব্যাপারে জনাথনের ভাষ্য, সু চির এ বক্তব্য অসত্য। রোহিঙ্গারা বহু বছর ধরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তাদের স্বাধীন চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আছে। অন্য অঞ্চলে বিয়ে করতে গেলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর এই বিধিনিষেধ আরও কঠোর হয়। এমনকি বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয়শিবিরে মাথা গোঁজা পরিবারের সদস্যরা বিশেষ অনুমতি ছাড়া অন্যত্র যেতে পারে না। সেখানকার শিশুদের পড়াশোনা অন্তত পাঁচ বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। চার বছর আগে রাথেডাংয়ের একটি গ্রাম পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এই সাংবাদিক বলেন, সেখানকার রোহিঙ্গারা চিকিৎসার জন্যও অন্য কোথাও যেতে পারেন না। (প্রথম আলো,
২০ সেপ্টেম্বর)
এ প্রসঙ্গে মার্কিন জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ ড. গ্রেগরি এইচ স্ট্যানটন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অং সান সু চি একজন মানবাধিকার প্রবক্তা, একজন নোবেলজয়ী হিসেবে তার যে বিশ্বাস, যোগ্যতা, সেসব তিনি বিসর্জন দিয়েছেন। সু চির সর্বশেষ ভাষণ তার অপারগতার আরেকটি ব্যর্থতার নজির। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি তিনি তার সরকারের বর্ণবাদী নীতির সপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে তার পিতার সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কারণ, বার্মার মূল সংবিধানে রোহিঙ্গাসহ সব গোষ্ঠীকেই বার্মার নাগরিক হিসেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এবার একটি ব্যতিক্রমি উদ্যোগ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে, প্রতীকী বিচারে মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার ও দেশটির সামরিক বাহিনীকে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ‘দোষী সাব্যস্ত’ করেছে মালয়েশিয়ার ‘আন্তর্জাতিক গণ-আদালত’। প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি, বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিল ও সাক্ষ্য গ্রহণের ভিত্তিতে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের মিলনায়তনে জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করা হয়। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শনকালে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক বলেন, মিয়ানমার যেটি করছে, সেটি গণহত্যার শামিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যা ঘটেছিল, মিয়ানমারের আরাকানে অনুরূপ ঘটনাই ঘটছে।
অথচ, এপারে আমরা দেখলাম ভিন্ন চিত্র, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে গিয়ে সেখানে অবস্থানরত শিশুদের পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনেন। সেখানকার নারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কান্নাজড়িত মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে পা ছুঁয়ে তাকে সালাম করতে এগিয়ে যান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা ¯্রষ্টার কাছে শোকরিয়া আদায় করতে থাকেন। তারা কান্নায় প্রলাপের মতো বলতে থাকেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের চায় না। ভিনদেশি প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেখতে এসেছেন। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন। পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী এক কন্যাশিশুর পরিস্থতি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিশুটির গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন তিনি। রোহিঙ্গা শিশুরা জানেন না তাদের কী অপরাধ। কেবল ঘর পুড়ে যেতে দেখেছে। কেউবা বাবা মা’কে হারিয়ে মুহূর্তে এতিম হয়ে কেবল প্রাণটা হাতে নিয়ে এসেছে অপরিচিত কারোর হাত ধরে। আশ্রয়দাতা দেশের প্রধানমন্ত্রী তাদের মধ্যে এসেছেন দেখে এই শিশুটিরও ভরসার জায়গা মিলেছে। সব রোহিঙ্গাকে আর ফেরত নেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন সভ্যতার এই অসহায় মানুষদের এবং রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আবাস তৈরির জন্য কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং মৌজায় বর্তমান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে নতুন করে ২ হাজার একর জমি বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সেখানে তৈরি করা হবে হাজার তাঁবু। আর ত্রাণ বিতরণ ও তাঁবু তৈরি সহ সার্বিক শৃঙ্খলার সেখানে করা হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।
আর তাই সকল রোহিঙ্গার চোখেমুখে কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসা মানবিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার প্রতি। এখানে একটি ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়- রাখাইন রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই মিলেছে ২০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী খাদিজার। শরণার্থী আশ্রয় কেন্দ্রই সন্তান প্রসব করেন তিনি। খাদিজা বলেন, দেশে স্বামীকে হারিয়েছি। সরকার আমাকে আশ্রয় দেয়নি উল্টো ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই কারণে কৃতজ্ঞতা জানাতে মেয়ের নাম রেখেছি, ‘শেখ হাসিনা’। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরে পাবার জন্য সরব রয়েছেন। আমরা সর্বশেষ দেখেছি, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে বেশির ভাগ অংশজুড়েই ছিল রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। সহিংসতা, হত্যা, নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ সমস্যা সমাধানে তিনি কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও তুলে ধরেন। যা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। আর তাই সব মিলে বিশ্ব গণমাধ্যমে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আরও বেশি জায়গা করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্বের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যমে প্রশংসিত হচ্ছেন। ওইসব গণমাধ্যমে তাকে মানবিক এক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। সব জায়গাতেই তার একটি কথাকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে- ‘যদি আমরা ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারি, তাহলে আরও পাঁচ অথবা সাত লাখ মানুষকেও খাওয়াতে পারব।’
লেখক: আইনজীবী ও সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম/ সম্পাদনা: আশিক রহমান