বিইআরসিতে বিদ্যুতের দাম কমানোর প্রস্তাব
(প্রথম পৃষ্ঠার পর) ৩৪(২)(খ) উপধারা মতে, দামহারের সঙ্গে যৌক্তিক উৎপাদন ব্যয়হার সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, ৩৪(২)(গ) উপধারা মতে, নূন্যতম বা স্বল্পতম বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নিশ্চিত করা এবং ৩৪(২)(ঘ) উপধারা মতে, ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
স্বল্পতম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিতকরণে বিইআরসির আদেশ প্রতিপালিত না হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এবং বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ বাড়ছে। পাইকারি বিদ্যুতের দামহার বৃদ্ধির প্রস্তাব তারই প্রমাণ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি মিশ্রে গ্যাস, ফার্নেসওয়েল ও ডিজেলের অবদানই মুখ্য। তাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসাবে গ্যাস ৬৭.৩৮ শতাংশ, ফার্নেসওয়েল ১৭.২৮ শতাংশ ও ডিজেল ৪.১১ শতাংশ। পরবর্তীতে ফার্নেসওয়েল ও ডিজেলের অনুপাত বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ব্যবহার ৫০১৯.৩২ কোটি ইউনিট। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৩৯১.৫০ কোটি ইউনিট। বর্তমানে পাইকারি বিদ্যুতের দামহার ভারিত গড়ে ৪.৯০ টাকা। কিন্তু ৫ পয়সা ঘাটতিতে সে মূল্যহার ৪.৮৫ টাকা ধরে ৭২ পয়সা রাজস্ব ঘাটতি পূরণে দামবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ স্বল্পতম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়হার কমানোর কোনো কৌশল গ্রহণ করা হয়নি। ফলে পাইকেরি বিদ্যুতে আর্থিক ঘাটতি বাড়ছে। সে ঘাটতি সমন্বয়ের অজুহাতে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিইআরসিতে প্রক্রিয়াধীন দামহার বৃদ্ধির ওই প্রস্তাব। ফলে এ প্রস্তাব ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়। অতঃপর বিদ্যুৎ উৎপাদনে আর্থিক ঘাটতি ও ক্ষতি খতিয়ে দেখা হয়েছে। তারই ভিত্তিতে ক্যাব পাইকারি বিদ্যুতের দামহার ১.৩২ টাকা কমানোর প্রস্তাব করেছে। আবেদনে দামহার কমানোর যৌক্তিকতায় বলা হয়েছে।
১. পাইকারি বিদ্যুতের দামহার ৭২ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ একদিকে রাজস্ব চাহিদাহারে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে : (ক) বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, (খ) ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, (গ) পাইকারি বিদ্যুতের দামহারে ঘাটতি ৫ পয়সা, (ঘ) দরপতন সমন্বয়কৃত দামহারে ফার্নেসওয়েল পরিবর্তে মেঘনাঘাট আইপিপিতে ডিজেল ব্যবহারে ঘাটতি ১৪ পয়সা; অন্যদিকে আয়হারে অন্তর্ভূক্ত হয়নি : (ক) ভোক্তাপর্যায়ে ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুৎ বিক্রিতে উদ্বৃত্ত আয় ৮ পয়সা এবং (খ) পাওয়ার ফ্যাক্টর জরিমানা আদায় বাবদ আয় ৪ পয়সা। সর্বমোট এই ৭৮ পয়সা প্রস্তাবিত দামহার বৃদ্ধিতে সমন্বয় হলে উদ্বৃত্ত হয় ৩২১ কোটি টাকা। তাতে দামহার ৭২ পয়সা বাড়ানো নয়, ৬ পয়সা কমানো যায়।
২. স্বল্পতম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে বিইআরসি’র আদেশ প্রতিপালিত হয়নি। প্রতিপালিত হলে : (ক) গ্যাসে মেঘনাঘাট আইপিপিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। ব্যয় সাশ্রয় হতো ১৩৩২.৯৭ কোটি টাকা। (খ) গ্যাসভিত্তিক ভাড়া-দ্রুতভাড়া বিদ্যুৎ ৩.৩৭ টাকা দামহারে কেনার পরিবর্তে ওই গ্যাসে সরকারি খাত উৎপাদনক্ষমতায় শুধুমাত্র ০.৮৬ টাকা জ্বালানি ব্যয়হারে ওই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। ব্যয় সাশ্রয় হতো ১৩০১.৪১ কোটি টাকা। (গ) ফার্নেসওয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির দরপতন সমন্বয় সমতা নিশ্চিত হতো। ব্যয় সাশ্রয় হতো ২১১১.৯১ কোটি টাকা। (ঘ) বেশি দামি ডিজেল বিদ্যুৎ কম উৎপাদন করার কৌশল গৃহীত হতো। সরকারি ও ভাড়াÑদ্রুতভাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় হতো ৭৪০.৭৯ কোটি টাকা। (গ) ভাড়াÑদ্রুতভাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট যৌক্তিক হতো। ফলে নন-ফুয়েল ব্যয়হার যৌক্তিক হওয়ায় ফার্নেসওয়েল ও ডিজেল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় হতো ৮৫৫.৮০ কোটি টাকা। অতঃপর ২০১৫-১৬ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় হতো কমপক্ষে ৬৩৪২.৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয়হার হ্রাস পেত ১.২৬ টাকা।
৩. পাইকারি বিদ্যুতের দামহার ৪.৯০ টাকা। উৎপাদন ব্যয়হার (৪.৯০-১.৩২) বা ৩.৫৮ টাকা। উদ্বৃত্ত ১.৩২ টাকা।
৪. ওপরে বর্ণিত তথ্য প্রমাণাদিতে দেখা যায়, বিদ্যমান দামহারে পাইকারি বিদ্যুৎ ভোক্তার নিকট থেকে ৬৬৬০.৮৮ কোটি টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও দামহার ০.৭২ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
৫. ভোক্তা পর্যায়ে তরল জ্বালানির দামহার নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসি’র। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সে দামহার এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে নির্ধারণ করে। যা অযৌক্তিক ও অসংগতিপূর্ণ। আবার সে দামহারে দরপতন সমন্বয় যৌক্তিক হয়নি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলকও করা হয়েছে। এমন দামহারের ভিত্তিতে বিদ্যুতের দামহার নির্ধারণ অন্যায় ও অযৌক্তিক। অতএব, পাইকারি বিদ্যুতের দামহারে ২ বছরে ৪ ধাপে উদ্বৃত্ত ১.৩২ টাকা সমন্বয় করে বিদ্যুতের দামহার ৪.৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩.৫৮ টাকা নির্ধারণ করার আদেশ গণশুনানীর ভিত্তিতে প্রদান করার জন্য আবেদনে ক্যাব প্রস্তাব করেছে। লেখকর : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ