‘ডিনামাইটবাবা’র জয়
কে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বললেন, ‘এখন না কী নোবেল নমিশনের মৌসুম চলছে। তাই সবাই নোবেল হবার চেষ্টায় আছেন। ভাবলাম, পুরস্কার প্রবর্তনের বিষয়টি আসলে খারাপ নয় এবং সে অর্থে ‘লোভ’ ব্যাপারটিকেও মন্দ বলা যায় না। ‘লোভ’ না থাকলে পাবার ইচ্ছা থাকে না, পাবার ইচ্ছা না থাকলে পুরস্কার বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, সাথে ‘নোবেল’ হবার চেষ্টাটাও তিরোহিত হয়। এমন চেষ্টা তিরোহিত হবার ঘটনায় ব্রহ্মান্ডের বিপদগ্রস্থ কিছু মানুষের ‘প্রাপ্তিযোগ’ তিরোহিত হবার সম্ভাবনাও ঘটে। সুতরাং ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ বিষয়টির ‘বিপজেটিভ’ দিক নিয়ে বিষদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বৈকী।
‘লোভ’ জয় করা সাধু-সন্যাসীদের অনেকে ‘নোবেল’ হিসাবে মানেন। মানেন আপত্তি নাই, কিন্তু তা শুধু ‘সত্যকালের জন্য, বর্তমান ‘কলিকালের ধরণ পুরাই উল্টা। এখন সব কিছুই ‘পুরস্কারের আশায় হয়। ভারতে ‘সুপারী’ বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। যারা ভারতীয় সিনেমা ও সিরিয়ালের ভক্ত তারা এক রায়ে ‘সুপারী’ বিষয়ক উইকিপিডিয়া হয়ে যেতে পারবেন। মোটা টাকার বিনিময়ে মানুষকে হত্যা করার যে চুক্তি তাকে ভারতীয়মতে ‘সুপারী’ বলা হয়, অন্যভাবে এটাকে হৃষ্টপুষ্ট ‘পুরস্কার’ সংবলিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কর্মকান্ড ও বলতে পারেন। বলতে পারেন ‘নোবেল’ এর সাথে ‘সুপারী’র সম্পর্ক কোথায়? পাল্টা প্রশ্ন ও উঠতে পারে তাহলে ‘সুচি’র সাথে ‘নোবেলে’র সম্পকর্ কী? প্রশ্নটা অদ্ভুত, কিন্ত উত্তরটা খুব বেশি অদ্ভুত নয়। বিদেশী বেনিয়াদের দেশের তেল, গ্যাস সম্পদ আহরণের বিনিময়ে ‘পুরস্কার’ বিষয়ক লোভের সাথেই রয়েছে‘নোবেলে’র সম্পর্ক। একজন বলেছিলেন, ‘যার যেটা নাই সেটাতেই সে লোভী হয়। ‘নাম-ক্ষমতা-অর্থ’ এই তিন পরস্পরের পরিপূরক বলা হলেও, সম্পূরক মুলত ‘নাম’ আর ‘অর্থ’। এ দুটি থাকলে মাঝেরটি তথা ‘ক্ষমতা’ এমনিতেই আসে। অং সান সুচি ‘নোবেল’ পেয়েছেন, পরবর্তীতে ‘ক্ষমতা’। অতএব, অন্য পরিপূরকটি পূরণে সচেষ্ট হওয়া তার পক্ষে ন্যায্য তো বটেই। ‘নাম আর অর্থ’ দুটো থাকলে দুনিয়াই তো হাতের মুঠোয়। অনেকটা ‘মোক্ষ’ লাভের পর ‘যক্ষ’ লাভের চেষ্টা। ‘যক্ষে’র ধন বিষয়টি জানেনতো। প্রাপ্তি লোভ সবারই আছে, ‘বাল্মিকি’ ডাকাত থেকে মুনি হয়েছিলেন ‘মোক্ষ’ প্রাপ্তির আশায়। বলি, এটা কী লোভ নয়। ‘বাল্মিকি’র ‘যক্ষ’ ছিল তাই লোভ ছিল ‘মোক্ষ’ প্রাপ্তির, সুতরাং ‘যক্ষওয়ালা কারো যদি মোক্ষের লোভ জাগে, তাতে দোষের কী!
‘পুরস্কার’ তথা ‘যক্ষ’ তথা ‘লোভ’ খুব খারাপ জিনিস নয় এটা প্রমান করতে এখন আর বেশি দূরে যেতে হয় না। ‘কলিযুগে’ রয়েছে ‘ইন্টারনেট’, এখানে খুঁজলেই পাওয়া যায় যাবতীয় দলিল দস্তাবেজ তথা প্রমান পত্তর। গেলো বারের আরাকান ক্রাইসিসে মগদের ‘রুটআউট’ প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গারা যখন দলে দলে বাংলাদেশে আসা শুরু করলো তখন একপাল ‘অহিংসবাদী’ রোহিঙ্গাদের সরাসরি ‘হিংসাবাদী’ তথা ‘জঙ্গি’ বলে বিশেষিত করলেন, সাথে ইয়াবা ব্যবসায়ী, অপরাধী হিসাবে ও তাদের আখ্যা দিলেন। অথচ দেখুন এবারের ক্রাইসিসে তাদের কর্মকান্ড পুরো রিভার্সে। ক্রিকেটের ভাষায় ‘রিভার্সসুইং’। আর্তমানবতার সেবায় তাদের আকুলতায় আপনি নিজেও কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে যাবেন। ভাববেন, মানবতার দৌড়ে আপনি এমন ‘নিও-স্প্রিন্টার’ দের থেকে পিছিয়ে পড়লেন নাতো! ভাবনার কিছু নেই, এসবি ‘নোবেলে’র গুণ, ‘মোক্ষ’ লাভের বিষয়।
বর্তমান দুনিয়ার দিকে তাকান, এখানে ‘লাভ’ আর ‘লোভ’ ছাড়া কিছুই নেই। কলিযুগে’র এই ‘কর্পোরেট’ দুনিয়ায় সবই ‘বিনিয়োগ’। এখানে কেউ ‘নাম’ বিনিয়োগ করে, কেউ ‘অর্থ’, মোটা দাগে সবই বানিজ্য, ‘বানিজ্যে বসতি লক্ষী’। বানিজ্যের প্রয়োজনেই এখানে সব চালিত হয়, কখনো সেবায় দেহ-মন সপে দেয়া, কখনো বা অন্যের দেহ-মন মেপে নেয়া, সবই চলে প্রায়োগিক হিসাবে। এমন হিসাবেই রোহিঙ্গারা ‘জঙ্গি’ থেকে হয় ‘নির্যাতিত’, প্রয়োজনে আবার হিসাব উল্টে যায়। আপাতত ‘নোবেল’ সেশন চলছে অর্থাৎ ‘মোক্ষ’ প্রাপ্তির লগন। এসময় সবাই ‘মাদার তেরেসা’। বলতে পারেন এর সবই ‘আলফ্রেদ নোবেল’ বাবার আর্শিবাদ। বোকার মতোন প্রশ্ন করতে পারেন, ‘আলফ্রেড নোবেল’ বাবাটা কে? উত্তর, যিনি ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন। অন্য অর্থে ‘ডিনামাইটবাবা’ও বলতে পারেন। চমকে উঠবেন না, ধ্বংস সৃষ্টির প্রসব বেদনা বৈ অন্য কিছু তো নয়। সুতরাং দ্বিধা ঝেড়ে বলে ফেলুন, জয় ‘ডিনামাইট বাবা’র জয়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ