এখনো গন্ধ পাই, মাকে মনে পড়ে
প্রতীক ইজাজ
মা বাগানে হাঁটতেন। হাতে তসবি। আমরা ঘরের ভেতর সুর করে কোরান পড়তাম। মা শুনতেন। মাথার ঘোমটা টেনে মুগ্ধ চোখে তাকাতেন আমাদের দিকে। আমাদের সুর আরও চড়ে যেত। মসজিদ থেকে বাবাও ফিরতেন। মাকে অনুনয়ের স্বরে বলতেন, হয়েছে, আর পড়তে হবে না, এখন ওদের নাস্তা দাও।
আমার সেই সকালগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। শুভ্র সবুজ সকাল। মা-বাবার মুগ্ধতা। সদ্য ফোঁটা রক্তজবা। ও নিয়েই তো আমাদের সর্বজনীন হতে শেখা।
যখন সবে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই উৎসব আমাদের দোলা দিত। সীমিত সামর্থ্যরে সংসারে সব উৎসবের আয়োজনই ছিল সমান। আমরা সব উৎসবের একই গন্ধ পেতাম। এখনো পাই। একই সুর বাজত মনে। এখনো বাজে।
বাসায় শবে বরাতের রাতে বা ঈদের নামাজ পড়া ছিল বাধ্যতামূলক, কিংবা শুক্রবারে জুম্মা, প্রাত্যহিক নামাজের জন্য কড়া শাসন; তেমনি দুর্গাপূজায়ও আমরা ভাসতাম উৎসবের তোড়ে। লম্বা ঘোমটা মুখ মা ও সফেদ সাদা আলখাল�া-বুক সমান দাড়ি বাবার সুখ্যাতি ছিল পরহেজগার মানুষ হিসেবে। সেই মা-বাবাই প্রথম শারদীয়ার ঢাক-ঢোল ও কাসার বাদ্যি কানে তুলেছিল আমাদের। ধর্মকে সহজ করেছিল। সব ধর্ম ও ধর্মের মানুষের প্রতি সমান অনুভূতি জাগিয়েছিল মনে। বলা যায় বাধ্য করেছিল চর্চায়।
দূর্গাপুজায় সেই শৈশব থেকে একধরণের গন্ধ পাই আমি। ধুপধোয়ার গন্ধ। মেলার গন্ধ। শরতের সন্ধ্যা বাতাসে ধুপধোয়ার এক নিশ্চেতন গন্ধ আমাকে পুলকিত করত, এখনো করে। পূজার তিনদিন বাবা আমাদের প্রতিদিনের জন্য ১০ টাকা করে দিতেন। মার হাতে টাকা দিয়ে বলতেনÑ ওদের মেলায় যেতে বলো। আমার ছেলেপুলের দল মেলায় যেতাম। ভাগ্নে-ভাগ্নিরা আসত। দুপুরের খাবার খেয়েই ছুটতাম মেলায়। বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে, মালতীনগর মন্ডপে বড় করে পূজা হতো। মেলা বসত। চাকা লাগানো মাটির ঘোড়া কিনতাম। মাটির পুতুল, হাড়ি পাতিল, চুলা। দূরবীণও কিনতাম। বাতাসা, ছাচ (চিনির হাতি ঘোড়া মাছ), নুকুল, ঝুড়ি। গরম জিলিপিও জুটত ঢোঙায়। কাগজের ঠোঙা। মা পছন্দ করতেন সাদা ঝুড়ি। সেটিও থাকত। সন্ধ্যা অবধি মেলায় ঘুরে, প্রতিমা দেখে, টমটম বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরতাম। মা অপেক্ষা করতেন। বলতেনÑ কী এনেছিস দেখি। চোখেমুখে আনন্দ নিয়ে মায়ের দিকে ঠোঙা বাড়াতাম। মা দেখতেন। পাছে কম পড়ে তাই কিছু একটা নামমাত্র তুলে মুখে দিতেন। বলতেনÑ রেখে দে, একটু একটু করে খাবি।
চোঙায় মুখ ঢুকিয়ে বায়োস্কোপ দেখতাম। মাথায় টোপর পড়ে, রঙিন জামা গায়ে, নেচে নেচে লোকটা গান গাইতো। হাতল ঘুরাতো। কত অবাক করা ছবি আসত চোখের সামনে। ববিতা, শাবানা, রাজা রানী। কী আনন্দ। মাত্র কয়েক মিনিট। আলো ঝলমল থেকে আবার মেলায়। পরে পায়ে ধুলো মেখে, দল বেধে হেঁটে বাড়ি ফেরা।
শৈশবে দশমির দিনে কেঁদেছি। মা’কে ডোবাবে। ধর্ম বুঝি না তখন। মেলা বুঝি। আনন্দ বুঝি। সেই মেলা, সম্মিলনের মায়ায় কাঁদতাম। মাঝে মধ্যে বোনদের সঙ্গে পাশের করতোয়া নদীতে যেতাম। দূর থেকে দেখতাম হুল্লোড় করে, চোখের জলে প্রতিমা বিসর্জন দিচ্ছে সবাই। ওদের কান্নায় আমিও কেঁদেছি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিÑ আহা, আবার এক বছর পর!
পূজা শেষ হতো, কিন্তু আমাদের আনন্দ শেষ হতো না! ওই যে মেলা থেকে কিনেছি খেলনাপাতি, সেগুলো তো শেষ হয়নি। ঘুম নেই, পড়া নেই। সুযোগ পেলেই সুতো লাগিয়ে বারান্দা মেঝেতে দুলকি চালে চলত মাটির ঘোড়া, নৌকা, হাতি। অবশ্য হাতির দাম বেশি ছিল। তাই খুব একটা কেনা হতো না। বেশি কিনতাম ঘোড়া। বাঁশি বাজাতাম। মা বকতেনÑ রাখ তো ওসব এখন, মেলা শেষ, পড়তে বস।
যখন বড় হয়েছি, শারদীয় দুর্গোৎসব আরও বেশি পেয়ে বসেছে আমাদের, সমবয়সীদের। খুব মনে আছে। রিপনরা থাকত বগুড়ার বড়গোলায়। বেশ বড় একটি পূজামন্ডপ ছিল ওখানে। ষষ্ঠীর আগের রাতে আমরা ভীড় করতাম ওখানে। মাকে থানে তুলতে হবে। রিপনই শিখিয়ে দিত সব। মন্ত্রোচ্চারণ, আচার আচরণ। নেচে নেচে, মন্ত্র পাঠ করে, মাকে থানে তুলতাম। প্রসাদ দিত। পরম তৃপ্তি নিয়ে খেতাম। কপালে চন্দনের তিলক একে পথে নামতাম। আনন্দ হুল্লোড় করতাম। এরপর চলত উৎসবের দোলা। টানা তিনদিন রাতভর রিপনদের সঙ্গে মন্ডপে মন্ডপে ঘুরতাম। দেখতাম। মার প্রতি মানুষের ভক্তি, অর্চনা। সবার সঙ্গে আমিও ভক্তিভরে প্রার্থনা করতামÑ মানুষের কল্যানে, শান্তিতে, ব্যক্তিগত অনুতাপ মোচনে। এখনো শারদীয় দুর্গোৎসব আমাকে টানে, গন্ধ পাই, ছুটে যাই মন্ডপে। আনন্দে নাচি, প্রসাদ খাই। কর্তাল কিনি। কপালে চন্দনের তিলক মেখে পথে নামি। প্রতিমা বিসর্জনে কষ্ট পাই। আরও একটি কষ্ট আছে ভেতরে। মার শোবার ঘরের তাকের ওপর টিনের কৌটায় তুলে রাখা সেই বাতাসা নুকুল ছাচের কষ্ট। আমরা ভাইয়েরা যখন বগুড়া ছাড়া, ঢাকায় পড়ি, সব পূজোয় যেতে পারতাম না। মা কষ্ট পেতেন জানতাম। পরে পূজো শেষে ছুটি পেলে বাড়ি ফিরতাম। মা ভারমুখ নিয়ে বলতেনÑ দেখ, তাকের ওপর ওই কৌটায় মেলার জিনিস কেনা আছে, খা। আমরা খুলতাম। দেখতাম ঠিক সেই হাতি ঘোড়া মাছ। সন্দেশ নুকুল লাড্ডু। আর মার প্রিয় সেই ঝুড়ি। কান্না চলে আসত আনন্দে। প্রাণ ডুবিয়ে খেতাম, যত না মিষ্টান্ন, তার চেয়ে বেশি মার ভালবাসা।
পূজো এলে মাকে মনে পড়ে। দুর্গাও তো মা। বাঙালির, মানুষের। বাবা ভীষণ নামাজি ছিলেন। মসজিদের ইমাম সাহেব বলতেন, রুস্তম চাচা (আমার বাবা) নামাজের কাতারে থাকলে ভরসা পাই। সেই বাবা আমাদের প্রথম অসাম্প্রদায়িক হতে শিখিয়েছে। ওই যে প্রতিদিন পুজার মেলায় যেতে ১০ টাকা করে দিতেন, আমরা যেতাম, সেখান থেকেই ধর্ম পরম্পরায় সহিষ্ণুতা হতে শেখা। অন্য ধর্ম, আদতে মানুষের প্রতি ভালবাসা, বাবাই শিখিয়েছেন। আর মা আকড়ে রেখেছেন উৎসবের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে, যেকোনো উৎসবে।
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান