বিশ্ব মিডিয়ায় নন্দিত শেখ হাসিনা, নিন্দিত সু চি
‘প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবন রক্ষায় সীমান্ত খুলে দিয়ে শেখ হাসিনা তার যে সহমর্মিতা ও সমানুভূতি দেখিয়েছেন, সে জন্য এ সপ্তাহে তার চেয়ে বড় কোনো ‘হিরো’ দেখছি না।’ এভাবেই বলছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা খালিজ টাইমস। পত্রিকাটির মতামত সম্পাদক অ্যালন জ্যাকব, ‘শেখ হাসিনা নোজ দ্য আর্ট অব কমপ্যাশন’ (শেখ হাসিনা জানেন সহমর্মিতার নৈপুণ্য) শীর্ষক ওই লেখাটি পোস্ট করেন ২৯ সেপ্টেম্বর।
জ্যাকব তার কলামে লিখেন, লেখার বিষয় নির্বাচনের আগে সব সময়ে আমাকে কোনো বিষয় এবং ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে ভাবতে হয়, এখানে স্বীকার করতেই হয় যে, এ সপ্তাহে আমার লেখার বিষয় দক্ষিণ ভারতের একজন অভিনেতা এবং রাজনৈতিক মাঠে তার আশাবাদী কর্মকা- নিয়ে লেখার বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিন্তু আমি যখন বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হচ্ছেন প্রাচ্যের নতুন তারকা, তখন আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। তিনি বলেন, হ্যাঁ মিয়ানমারে একজন নোবেল বিজয়ীর উজ্জ্বলতা হারানোর বিষয় নিয়ে মিডিয়া অধিক ব্যস্ত থাকায় আমরা এই মহৎ সুযোগটি হারিয়েছি। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক আবেদনটি অবজ্ঞা করায় একটি অপরাধের বোঝা আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেছেন, এতে তার হৃদয় ভেঙে গেছে।
নিবন্ধে জ্যাকব বলেন, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি যখন কণ্ঠস্বর হারিয়েছেন এমন সময় শেখ হাসিনার সোচ্চার হয়ে ওঠা এক বিরাট স্বস্তি। সু চি ও শেখ হাসিনা তাদের নিজ নিজ দেশের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়কের কন্যা। দুজনেই খুব কাছ থেকে ট্র্যাজেডি দেখেছেন। যদিও ফারাকটা বিশাল। মানবতা যখন বিপন্ন তখন একজন নিছক দর্শক হয়ে থাকার পথ বেছে নিলেন, অপরজন দেখালেন অমায়িক দয়া। শেখ হাসিনার প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছোট্ট দেশটিতে একবারে ৪ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘে অধিবেশন চলাকালে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে তিন লাখ শরণার্থী পেয়েছি, কিন্তু আমাদের স্থান সংকুলানের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আরও বেশি শরণার্থী গ্রহণের বিশাল হৃদয় আমাদের রয়েছে।’ জ্যাকব লিখেছেন, এটা ¯্রফে কোনো অনুকম্পার বিষয় নয়, এতে ট্র্যাজিক পরিস্থিতিতে সাহস প্রদর্শিত হয়েছে।
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে উদ্দেশ্য করে নিবন্ধটিতে জ্যাকব লিখেন, ‘যখন তার সবচেয়ে বেশি উচ্চকণ্ঠ হওয়ার দরকার ছিল, তখন তিনি সোচ্চার হতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তথাকথিত এই আইকনের জন্য আমার সহমর্মিতা নেই বললেই চলে। গণতন্ত্র যখন পছন্দসই সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে যায় তখন এটি ত্রুটিপূর্ণ ও বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। আর জান্তা ও একনায়কদের সঙ্গে সন্ধি করা সহজ হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে সু চি’র সুচিন্তিত নীরবতা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আমাদের একটি সম্পাদকীয়তে আমি এ কথা বলেছি। আরও বলব। যখন মানবতার জন্য চিৎকার করে কথা বলা উচিত তখন কারও নিশ্চুপ থাকাটা আমার অপছন্দ। অ্যালন জ্যাকবের মতো ঠিক একই সুরে মার্কিন জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ ড. গ্রেগরি এইচ স্ট্যানটন কয়েকদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘অং সান সু চি একজন মানবাধিকার প্রবক্তা, একজন নোবেলজয়ী হিসেবে তার যে বিশ্বাসযোগ্যতা, সেসব তিনি বিসর্জন দিয়েছেন। সুচির সর্বশেষ ভাষণ তার অপারগতার আরেকটি ব্যর্থতার নজির।’ ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, তিনি তার সরকারের বর্ণবাদী নীতির সপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে তার পিতার সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কারণ, বার্মার মূল সংবিধানে রোহিঙ্গাসহ সব গোষ্ঠীকেই বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতার বহু আগে থেকে রোহিঙ্গারা সেখানে বসবাস করে চলছিল। সুতরাং পিতার অনুসৃত নীতি থেকে ছিটকে বাইরে এসেছেন। এভাবে জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সুচির দ্বারা নৈতিকভাবে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন। বার্মা মিয়ানমার হওয়ার বহু আগে যে জেনোসাইড প্রক্রিয়া শুরু হয়, এখন অং সান সুচি তার দায়িত্বভার তুলে নিয়েছেন। এটা একটা স্ববিরোধিতা।’
খালিজ টাইমসের মতামত সম্পাদক অ্যালন জ্যাকব ওই নিবন্ধে একটি তুলনামূলক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখেছেন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে ১২ লাখ শরণার্থী গ্রহণের সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যতিক্রম, এর সম্পদ সীমিত। এটি বাংলাদেশ সরকারের কারণে সৃষ্ট কোনো জন¯্রােত নয়, তথাপি শেখ হাসিনা তার মানবিকতার জায়গা থেকে সরে যাননি।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক খ্যাতনামা লেখক, সাংবাদিক সদানন্দা ধুমি (গত ২৫ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিখ্যাত গণমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ‘বাংলাদেশ শো কমপ্যাশন’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেনÑ মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চিকে বিশ্ব মাথায় তুলে রাখলেও রোহিঙ্গা সংকটে নায়ক এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এই ইস্যুতে যে সহমর্মিতা তুলে ধরতে পেরেছেন, তা বিশ্বের অনেক বড় ও ধনী দেশের নেতারা দেখাতে পারেননি।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে এভাবে বিশ্বের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যমে প্রশংসিত হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইসব গণমাধ্যমে তাকে মানবিক এক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। সবশেষে খালিজ টাইমসের মতামত সম্পাদক অ্যালন জ্যাকবের একটি মন্তব্য দিয়ে লেখা শেষ করছি, ‘বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর মতো নেতারা যখন কর্ণধার হন, তখন অভিবাসন সমস্যা নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত বিশ্বে আশার আলো জ্বলে ওঠে।’
লেখক: আইনজীবী ও সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম
সম্পাাদনা: আশিক রহমান