‘মহৎ চুরি’, বাক ও শ্বাসরুদ্ধ মানুষ
ঘৃণিত হলেও চুরির মধ্যে সবচেয়ে ‘নোবেল’ চুরি হচ্ছে বই চুরি, এমনটাই জেনেছি ছোটবেলা থেকে। সুতরাং সব চুরিই দোষের নয়। মিশেল ফুকো’র লেখা চুরি নিয়ে কেন এত কথা হচ্ছে বুঝি না। লেখালেখি করেন যারা, তারা তো আমাদের মতোন আমজনতা নন, তার উপর যদি হয় গবেষণাপত্র, সে তো কঠিন ব্যাপার। আর যিনি লিখেন তিনি যদি হন সেলিব্রেটি, তাহলে তো সময় সংকুলানেরও তো একটা ব্যাপার রয়েছে। কারও চিন্তা তো মিশেল ফুকো’র হুবুহু হতেই পারে, কিংবা মিশেল ফুকো কারো ‘জেরক্স’ হতে পারেন। চিন্তা যদি একই হয়, তাহলে কেন সময় নষ্ট কিংবা অযথা কষ্ট, কপি আর পেস্ট করে দিলেই হয়। এমন ‘নোবেল’ কপি-পেস্ট নিয়ে এত কথা কেন, কেন এত লেখালেখি!
অবশ্য এ ধরণের লেখালেখির একটি ‘বি-পজেটিভ’ দিকও আছে। যিনি যত বিখ্যাত তিনি তত সমালোচিত। সে অনুযায়ী সামিয়া রহমান এগিয়ে আছেন। ‘প্লেজারিজম’ তথা নকলবাজির অভিযোগ রয়েছে প্রয়াত সৈয়দ হক ও ড. জাফর ইকবালের মতোন লেখকদের বিরুদ্ধেও। তবে এনারা কিন্তু এত সমালোচিত হননি, যতটুকু হচ্ছেন সামিয়া রহমান। সমালোচনার দৌড়ে সামিয়া ম্যাডাম সত্যিই এগিয়ে। অবশ্য মিশেল ফুকো’র ‘জেরক্স’ বলে কথা। ফুকো’র লেখায় ফুকি দেবার সাহস হয়তো অনেক চুনোপুটির রয়েছে কিন্তু দাঁত ফুঁটানোর জন্য অমন লেখা সত্যিই শক্ত। এমন মানুষের ‘জেরক্স’ কিংবা হালের ‘ক্লোন’ এগিয়ে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।
এতে গেল নকলবাজির অভিযোগের কথা। কিন্তু এমন ‘বাজি’র বাজিকর কী শুধু সামিয়া রহমান বা মারজান কিংবা ওরা পাঁচজন? আরেঠারে শুনিতো অনেক বাজিকরের কথাই। তবে কী এই পাঁচজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা দ্বন্দ্বের ‘স্কেপগোট’। সাবেক ভিসির সঙ্গে সামিয়ার রহমানের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। ক্ষমতাচ্যুতরা সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের ক্রোধের শিকার হন। সামিয়া রহমানসহ পাঁচজনও কী এমনতর শিকার? কিছু দিন আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের ছ’শটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছিল, এখন নেমে সাত’শ ছাড়িয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি বাজিকর’দের আস্তানায় পরিণত হয় তাহলে তো পরিণতি এমনটাই হবার কথা। বাংলা সাহিত্যের স¤্রাট হুমায়ূন। সেই হুমায়ূন আহমেদ নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও নিজ গোত্রের অনেকের সম্পর্কে খুব একটা সুখকর মন্তব্য করেননি। তিনি তার এক লেখায় মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, এই শিক্ষকদের অনেকেই উর্দু হরফে আয়ুবিয় বাংলা লেখন পদ্ধতি বিষয়ক কর্মযজ্ঞে দলবেধে নেমে পড়েছিলেন। আবার অনেকেই স্বাধীনতা পরবর্তীতে দলবেধে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। শামসুর রাহমানের ভাষায়, ঝাকের কই ঝাকে মিশে যাবার মতোন ব্যাপারস্যাপার, যা এক কথায় আত্মঘাতি। এমন আত্মঘাতী প্রবণতা শিক্ষকদের পেয়ে বসলে মহা মুসিবত। কারণ শিক্ষার্থীরাও এতে আক্রান্ত হবেন। আত্মঘাত বহন করবেন মননে, আত্মস্থ করবেন মেধায়।
এর প্রমাণ অবশ্য ইদানিং পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, আমার একজন ‘ক্রিটিক’ প্রশ্ন করলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য চালের সংকট, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সংকট, এমন কী পর্যটন নগরীর সৌন্দর্য্য সংকট নিয়েও কথা চাউর রয়েছে। এ ব্যাপারে অনেকে লিখছেন এবং বলছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য ‘অক্সিজেনের সংকট’ এমনটা কী আপনার জানা আছে?’ মধ্যরাতে এমন বেতালা প্রশ্নের মুখে কী বলি? উল্টো প্রশ্ন করলাম ঘটনা কী?
‘ক্রিটিক’ ভদ্রলোক জানালেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক প্রতিবেদনে প্রতিবেদক বলেছেন, রোহিঙ্গাদের গাছ কাটার দরুণ নাকি অক্সিজেন সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে, এমন কথা। এটুকু বলেই ক্ষান্ত দিলেন না, জানতে চাইলেন, ‘অক্সিজেন কী ত্রাণের চাল, ওরস্যালাইন, তাবু না লেট্রিন।’ বেচারার কথাবার্তার ধরণটাই এরকম, বিশেষ করে গণমাধ্যম কর্মীদের পেছনে লাগার ক্ষেত্রে তিনি এক পা এগিয়ে। তাই তার কথায় আর ‘রা’ না করে, মিশেল ফুকো’র অনুবাদ পড়ার চেষ্টা করলাম।
পড়তে গিয়ে বুঝলাম, এত সহজে মিশেল ফুকোতে দাঁত ফুঁটানো আমার কম্ম নয়। ‘অক্সিজেন সংকট’ বিষয়টি মাথায় ঘুরছিল। ভাবলাম ঢাকার লোকসংখ্যা কত? দেড় কোটি? আচ্ছা ‘সভ্যতা আর উন্নয়ন’ তো শিল্পের রূপে গাজীপুর, জয়দেবপুরের গহন শালবন বিনাশ করে ভালুকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। সে হিসাবে দেড় কোটি ঢাকাবাসী’র তো কবেই শ্বাসরুদ্ধ হবার কথা। বাকরুদ্ধ মানুষ না হয় বেঁচে থাকে, কিন্তু শ্বাসরুদ্ধ মানুষ কী বাঁচে, তবে কী আমরা বেঁচে নেই!
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান