রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে তিনটি কাজ করতে হবে
রাজেকুজ্জামান রতন
রোহিঙ্গা ইস্যুটা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে সৃষ্ট। কিন্তু তার ফলাফলের পুরোটাই বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার তার যে নাগরিকত্বের আইন করে, সে আইনের ফলেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। মিয়ানমারের পাশেই বাংলাদেশ, আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাও আছে, ৭৮ সালের অভিজ্ঞতাও আছে। মিয়ানমারে যখনই কোনো নির্যাতন নিপীড়ন করা হয়, তখনই অসহায় মানুষেরা আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশে চলে আসে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের শুরু থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাংলাদেশের ওপরে এসে পড়বে কেন? ফলে আমাদের দেশ থেকে একটি কূটনৈতিক তৎপরতা সব সময়ই জোরদার রাখার দরকার ছিল। মিয়ানমার যেহেতু আসিয়ানের সদস্য, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াও সদস্য এবং রোহিঙ্গা শরনার্থীদের একটা বড় অংশ বাংলাদেশে যেমন আছে কিছুটা অংশ মালয়েশিয়াতেও গিয়েছে, কিছু ইন্দোনেশিয়াতেও গিয়েছে। থাইল্যা- এবং নেপালেও কিছু গিয়েছে। ভারতেও আছে। ফলে এটাকে আর্ন্তজাতিক বিষয় হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা সবসময়ই জোরদার করা দরকার ছিল। সেটা আমরা খুব ভালোভাবে করতে পারিনি। তার ফলাফল এবারে দেখা গেল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বেঠকেও এ বিষয়টা ততটা গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদেও ভেটোর মুখোমুখিতে পড়ে নাকচ। এসবের কারণ হলো, সেখানে মিয়ানমারের ভূ-রাজনৈতিক এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে চীনের একটি বিরাট বিনিয়োগ আছে। ভারতও সুবিধা নিতে চায়। রাশিয়ারও বিনিয়োগ আছে। সব মিলিয়ে ভারত, চীন, রাশিয়ার কাছে মিয়ানমার অর্থনৈতিক ও
ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আবার অন্যদিক থেকে দেখুন, বাংলাদেশের সাথে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক বাণিজ্য চীনের। তারপরেই ভারতের এবং বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ রয়েছে রাশিয়ার। তাহলে ভারত, চীন, রাশিয়া যারা মিয়ানমারকে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে, আমাদের রাষ্ট্র তাদের সঙ্গে কিন্তু ভালোভাবে ডিল করতে পারেনি। যেটা করতে পারলে আমাদের দেশেও তাদের বিনিয়োগ আছে। তাহলে কেন এই ইস্যুর ক্ষেত্রে তারা পুরোপুরি মিয়ানমারের দিকে ঝুঁকে পড়বেন? আমাদের রাষ্ট্রের আরেকটা দুর্বলতা ছিল মিয়ানমারের ইস্যুটাকে শুধু মুসলিম ইস্যু হিসেবে দেখা। এটাকে মুসলিম ইস্যু হিসেবে না দেখে এটাকে মানবিক সমস্যার ইস্যু হিসেবে দেখা দরকার ছিল। আমাদের দেশের অভ্যন্তরেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন যে মাঝে মাঝে নির্যাতন, নিপীড়নের মুখোমুখি হয়ে পড়ে, এর বিপরীতে যদি রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াত, জনগণের মাঝে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত থাকত, তাহলে এটাও আমরা গোটা বিশ্বে একটা মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে পারতাম যে, বাংলাদেশ যেমন একটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ফলে পৃথিবীর যেখানেই নির্যাতন নিপীড়ন হবে, সেখানে আমরা তার প্রতিবাদ যেমন করব, নিপীড়িত মানুষের পাশেও দাঁড়াব। এই দিকগুলো আমাদের দেশের জনগণের মননের মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। এখন যখন সু চির প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসছেন, তখন আমাদের রাষ্ট্রের উচিত হবে, সু চির কাছে বলা যে, এই সমস্যাটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ। তোমাদের নাগরিক তোমরা ফিরিয়ে নাও। আমাদের দুর্বলতা ছিল এই যে, লাখ লাখ যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে তাদের পরিচয় কী? আমাদের সীমান্তের পনেরো-ষোলটা পয়েন্ট দিয়ে তারা এসেছে। আমাদের বর্ডার গার্ড, আমাদের আর্মি তারা যদি নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে রাখত তাহলে ভাল হতো। মিয়ানমার যখন বলবে ওদের কাগজ থাকলে ওদেরকে নেব, তখন কী করবেন? ওরা জীবনের ভয়ে পালিয়ে এসেছে। ওরা কাগজ নিয়ে আসবে কোথা থেকে? কাগজ তো আমরা তৈরি করতে পারতাম। এই নাম, এই ঠিকানা, এই তার আঙুলের ছাপ। এই ডকুমেন্টসটা বাংলাদেশ সরকার খুব ভালোভাবে তৈরি করতে পারেনি। ফলে এটা বাংলাদেশের বিশেষ দুর্বলতা। তবে কাজ শুরু করেছে, যদিও দশদিন পর।
ক্যাম্পের বাহিরে এক লাখের ওপর রোহিঙ্গা আছে। আগে থেকে আছে তিন লাখ। তাদের কি হবে? এবারেরটাও তো পুরোপুরি হয়নি। ফলে এটা একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা হিসেবে নেওয়া উচিত ছিল। আমাদের এখন তিনটা কাজ। প্রথমতÑ তাদেরকে ফিরিয়ে নিতে আর্ন্তজাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। দ্বিতীয়ত রোহিঙ্গারা যারা আছে তাদের আশ্রয়, নিরাপত্তা, জীবিকার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া। তৃতীয়ত দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ তৈরি করা যে, আমাদের এই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে কোনো মানুষ ধর্মের কারণে বা আঞ্চলিকতার কারণে নির্যাতিত হয় না। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দেশ । আমরা নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানোর মতো দেশ। নিপীড়কের বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক ভূমিকাও আমরা নিবো।
পরিচিতি: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাসদ
মতামত গ্রহণ: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান