মিয়ানমারের নৈতিকতাবিহীন ডিপ্লোমেসির খপ্পরে বাংলাদেশ
প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে আমাদের সাথে যে দ্বি-পাক্ষিক ডিপ্লোমেসিটা করেছে, সেটা সম্পূর্ণরূপে ধোঁকাবাজি। এটাকে আমরা চাণক্যনীতি বলি। চাণক্যনীতিতে উদ্দেশ্যটা সফল করাই করাই আসল ব্যাপার। আপনি কোন পদ্ধতিতে এটা সফল করেন এটা বিবেচ্য নয়। এটা হতে পারে অনৈতিক। এটা হতে পারে বর্বর বা নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে। কিন্তু আপনি আপনার উদ্দেশ্য সফল করবেন, এটাই বড় কথা।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুতে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আমি যা পড়েছি বা পর্যবেক্ষণ করেছি, সেটা পুরোপুরি চাণক্যনীতির মতো। যেমন তারা কথা দিয়েছে, কথা রাখেনি। বারবার কথা দিয়েছে, কিন্তু কখনো কথা রাখেনি। শেষ পর্যন্ত তারা যেটা করেছে বাংলাদেশের সঙ্গে, যেটা বাংলাদেশ বুঝতে পারেনি। আমি একটা পটভূমি দিচ্ছি, ২০১৫ সালে তারা আমাদের সাথে একটা এগ্রিমেন্ট করে, প্রথমে তারা রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলত। এগ্রিমেন্ট করা হয় যে, আমরা বাঙালিও বলব না আবার রোহিঙ্গাও বলব না। এটা ছিল একটা ভুল পদক্ষেপ। কারণ, তারা বাঙালিও নয়, বাংলাদেশিও নয়, রোহিঙ্গারা একটা জাতি। ওরা নবম শতাব্দী থেকে সেখানে বাস করছে। রোহিঙ্গাদের ইতিহাস পড়ে দেখুন, ওরা একটা আলাদা জাতি। আরাকান নামে একটা মুসলিম রাষ্ট্র ছিল ওখানে। সেখানকার লোক ওরা। এখন মিয়ানমারে যেটা চলছে সেটা হলো মুসলিমদের উপর সন্ত্রাস। ওখানে একটা বুদ্ধিস্ট স্টেট আছে, সেখানকার মগরা টেরোরিজম চালাচ্ছে, রাস্ট্র তাদের সহযোগিতা দিয়েছে।
অং সান সু চি কফি আনান কমিশনকে ডেকে বলেছিল, এদেরকে তুমি রোহিঙ্গা বলতে পারবে না। কী বলবে? বলবে মুসলিম। এখন এই ডেফিনেশনে রোহিঙ্গাদের আপনি কী ক্যাটাগরিতে ফেলবেন? না বাঙালি, না রোহিঙ্গা, শুধু মুসলিম? এখন যখন তারা বলছেন যে, আমরা ফেরত নিব, তখন আমি বিশ্বাস করি, এটা বাংলাদেশের একটা ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছে। কারণ, এর দ্বারা তারা পৃথিবীকে দেখাতে পারবে যে, আমরা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিচ্ছি এবং আন্তর্জাতিক চাপটা তখন অনেক কমে আসবে। যদিও আন্তর্জাতিক চাপ তাদেরকে কেউ দেয়নি বা মুখে মুখে যতটুকু দিয়েছে সেটাও কমে আসছে। জাতিসংঘ কয়েকটা এলাকার কথা বলেছে যেখানে ৩০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে, ১২ লাখই আমাদের দেশে। বিভিন্ন দেশে গিয়েছে অন্যরা। এখন পর্যন্ত যেখানে নির্যাতন বন্ধ হয়নি, যেখানে এখনো রোহিঙ্গা আসছে, তার মধ্যে আপনি কেমন করে ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন? বাংলাদেশ এখন বলবে যে, নির্যাতন বন্ধ করো। তা না করে আপনি একটা ওয়ার্কিং গ্রুপ করে বসলেন? আমার অভিমত হলো, মিয়ানমারের যে নৈতিকতাবিহীন ডিপ্লোমেসি, বাংলাদেশ সেটার খপ্পরে পড়েছে। অনেকে অং সান সু চিকে বাদ দিতে চায়। বলে যে সে কিছুই জানে না। আপনি কী ইয়াহিয়া খানকে বাদ দিবেন পাকিস্তানের হিস্ট্রি থেকে? এরকম কথা কী করে বলে লোকে? এরকম ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আমাদের কপালে আরও অনেক দুঃখ আছে। ১২ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে অস্থিতিশীল করে দিতে পারে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথমেই বলা দরকার ছিল-তোমরা নির্যাতন বন্ধ করো। তারপর আমরা কথা বলব। কিন্তু সেটা কী করেছি আমরা?
পরিচিতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
সাক্ষাতকার গ্রহণ: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান